সরকার পদত্যাগের এক দফার আন্দোলনের ধরণ ‘ভিন্ন রকম’ হবে বলে জানিয়েছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।শনিবার বিকালে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে ঈদ পরবর্তি শুভেচ্ছা বিনিময়কালে চলমান আন্দোলন সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব একথা জানান।তিনি বলেন, ‘‘ তারুণ্যে সমাবেশ হচ্ছে, সামনে আমাদের পদযাত্রার কর্মসূচি শুরু হবে। আমরা আশা করি যে, একদফাতে আমরা আন্দোলন শুরু করব। অর্থাত আমাদের যে ১০ দফা, অন্যান্য যুগপত আন্দোলনকারী দলগুলো আছে তাদের দফাগুলো মিলিয়ে একটা দফায় আন্দোলনে যাবোৃসেটা হচ্ছে যে, এই অবৈধ সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্ত করা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন এবং নতুন নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠানৃ এগুলোকে নিয়ে আমরা একটা জায়গায় আসছিৃ সেটা হচ্ছে যে, মূলত এই সরকারের পদত্যাগ।”
‘‘ সেটা নিসন্দেহে গত আন্দোলনগুলোর চাইতে ধরনও হবে একটু ভিন্ন এবং জনগনের সম্পৃক্ততাও বাড়বে। একটা ব্যাপারে আমরা নিশ্চয়তা দিতে পারি যে, আমাদের এই আন্দোলন প্রথম থেকেই যেটা শুরু করেছি সেটা হচ্ছে যে, জনগনকে সম্পৃক্ত করে আন্দোলন। এই আন্দোলনে জনগনের অনেক বেশি সম্পৃক্ততা আসবে। আমি বিশ্বাস করি, এই আন্দোলনের মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে সরকার বাধ্য হবে নতি স্বীকার করে পদত্যাগ করে একটা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে।”
এক দফার আন্দোলনের ধরন কেমন হবে, হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি থাকবে কিনা জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘ আমরা আগেই বলেছি, আমরা হরতাল-অবরোধের মতো কোনো কর্মসূচিতে সচেতনভাবে চাচ্ছি না। আমাদের ভায়োলেন্সে যাওয়া প্রশ্নই উঠতে পারে না।”
‘‘ সরকার যদি কোনোভাবে ওইসব দিকে ঠেলে দেয় তা সরকারের দায়। শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনটা করছি, শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনে আমরা চূড়ান্ত পর্যায়ে যেতে চাই।”
‘সরকারের উন্নয়ন বিভ্রম’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘ এই সরকারের সবচেয়ে বড় অপরাধ যে, জনগনকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করা। কয়েকটা বইও বেরিয়েছে যে, বাংলাদেশের উন্নয়নের যে একটা ব্যাপার বার বার বলা হচ্ছে, এটা আসলে উন্নয়ন বিভ্রম। এটা মানুষকে বোকা বানানো হয়,প্রতারণা করা হয়। যা পরিসংখ্যানের তথ্যের মধ্যে অনেক কিছু সরবারহ করা হয় যে তথ্যগুলো সঠিক নয়।এটা আজ থেকে নয়, এই সরকার আসার পর থেকেই।”
‘‘ আপনাদের মনে আছে কৃষি মন্ত্রণালয় তখন মন্ত্রী ছিলেন মতিয়া চৌধুরী। তার নির্দেশে বাংলাদ্শে পরিসংখ্যার ব্যুরো সেখানে নির্দেশ দেয়া ছিলো তার সঙ্গে কথা না বলে কোনো কিছু দেয়া যাবে না। অর্থাত উনারা যেটা বলবেন সেটাই পরিসংখ্যান ব্যুরোতে দিতে হবে।যার ফলে এই গ্রোথের রেইট(প্রবৃদ্ধির হার), ইনকাম বলেন, প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট-ফরেন ইনভেস্টমেন্ট বলেন সব ক্ষেত্রেই আপনি যদি গভীরে যান এবং অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে কথা বলে তাহলে দেখবেন যে, প্রতিদিনেই আপনাকে ভ্রান্ত ধারনা দেয়া হচ্ছে, ভুল ধারনা দেয়া হচ্ছে।”
প্রশ্ন রেখে সাবেক কৃষি প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘‘ এতোই যদি উন্নয়ন হয়ে থাকে, কৃষি ক্ষেত্রে যদি স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে থাকে তাহলে আজকে কেনো প্রতি বছর প্রায় ৫৪ লক্ষ মেট্রিক টন খাদ্যশষ্য আমদানি হয়? মরিচের দাম বেড়েছে, আদার দাম তো একদিনে ২‘শ টাকা কেজিতে বেড়ে গেছে। এরকম প্রক্যেকটা আইটেমের দাম বেড়েই চলেছে।”
‘‘ দেশটাকে তারা মূলত আমদানী নির্ভর করে ফেলেছে। এর কারণটা হচ্ছে একটাই, আমদানি করতে গেলে যে কমিশন পাওয়া যায়, যে লাভটা হয় এটাই হচ্ছে প্রধান বিষয়। এই সরকারের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে লুট করা। আমি বলি যে, বর্গীদের মতো। বাংলাদেশে বর্তমানে যে অবৈধ সরকার ক্ষমতায় চেপে বসে আছে তাদের আচরণ পুরোপুরি বর্গীদের মতো। আসবে লুট করে নিয়ে চলে যাবে। সমস্ত জায়গায় চুরি, সমস্ত জায়গায় দুর্নীতি.. এটাকে তারা উন্নয়ন বলে। সেজন্য ওরা বাগাড়ম্বর করে কথা বলে।”
‘সরকার মিথ্যা তথ্য দিয়ে জনগনকে বিভ্রান্ত করছে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘ যখন অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে, ধসে পড়ছে, যখন অর্থনৈতিক বিপর্যয় শুরু হয়েছে, যখন জনগন তাদের দূ:খের কথাগুলো বলতে শুরু করেছে, ইনফ্লেশন এমন একটা পর্যায় পড়ে গেছে যে, মানু্ষরে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকছে না তখন সরকার উল্টো কথা বলে জনগনকে বিভ্রান্ত করছে। এতে কোনো লাভ হচ্ছে না। কিছুদিন আগে ইন্টান্যাশনাল মিডিয়াতে এসেছিলো সেই উন্নয়নের স্বপ্ন যেগুলো তারা(সরকার) দেখাচ্ছিলো সেগুলো মিরীচিকায় পরিণত হয়েছে
‘‘ সেজন্য আমরা মনে করি যে, এনাফ ইজ এনাফৃ এখনও সময় আছে এই সরকার পদত্যাগ করে নিরপেক্ষ সরকারের কাছে ক্ষমতা দিয়ে চলে যাওয়া উচিত। এটা তাদের জন্য ভালো হবে, দেশের জন্য মঙ্গল হবে।”
‘সংকট উত্তরণ সরকারেই হাতে’
নির্দলীয় সরকারের বিষয়টি সংবিধানে সংযোজন ‘সরকারের দায়িত্ব’ বলে উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘‘ তাদের দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্টতা আছে। এটা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছে সরকারের সদিচ্ছার ওপর। সরকারের জনগনের প্রতি যদি ভালোবাসা থেকে থাকে, দেশের প্রতি যদি কোনো প্রেম থাকে তাহলে নিসন্দেহে তাদের দায়িত্ব হচ্ছে যে, এই রাজনৈতিক সংকটা মোকাবেলা করার জন্য তাদের সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।”
‘‘ আলোচনা করেই তারা একটা পথ বের করতে পারে। এটা অতীতে বাংলাদেশে হয়েছে তোৃ দুইবার-তিনবার-চারবার হয়েছে। এটা খুব কঠিন কাজ না। বাট ইউ নিড যে, তাদের একটা গুড ইনটেনশন থাকতে হবে, দেশের প্রতি ভালোবাসা থাকতে হবে তাহলে সেটা হবে। প্রয়োজনীয় সংশোধনী করতে হবে, রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করতে হবে তাহলে একটা পথ তৈরি হবে।”
‘ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য প্রসঙ্গে’
জামায়াতে ইসলাম বিএনপির বি-টিম আওয়ামী লীগের বক্তব্য নাচক করে দিয়ে মির্জা ফখরুল বলেম, ‘‘ এগুলো বাজে কথা। তারা ইচ্ছা করে এসব কথা। আমরা এসব কথা উত্তর দিতে চাই না। জনগনই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাদের কথাগুলোর উত্তর দিয়ে দেবে।”
‘‘ এবার যে জনগনকে সম্পৃক্ত করে আন্দোলনটা শুরু হয়েছে তাকে ভ্রান্ত দিকে নিয়ে যাওয়া, আবার একটা ইস্যু তৈরি করে সেটাকে অন্যদিকে দিয়ে যাওয়া, ইস্যু পরিবর্তন করা ৃ এসবের কোনো সুযোগ এবার তারা পাবে না।”
জামায়াতে ইসলাম নিয়ে দলের অবস্থান কি জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘‘ জামায়াত একটা রাজনৈতিক দল, অনেক ধরে রাজনীতি করছে, জাতীয় পার্টিরও রাজনৈতিক দল। যদি এখন জামায়াতের নিবন্ধন নেই। আমি ঠাকুগাঁওয়ে যে কথাটা বলেছিলাম যে, জামায়াতে ইসলামী একটা রাজনৈতিক দল, সে তার নিজস্ব ধারায় রাজনীতি করছে।”
‘‘ আমাদের মূল কথাটা হচ্ছে যে, সরকারের বিরুদ্ধে যারাই আন্দোলন করবে তাদেরকে ধন্যবাদ দেয়া উচিত, সেই তারা নিজেরা করবে। আমরা যুগপতভাবে আন্দোলন করছি, আমরা জোটবদ্ধ আন্দোলন করছি না। প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দল যারা মনে করে যে, এই সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা উচিত তারা করতে পারেৃ এটা স্বাভাবিক। কমিউনিস্ট পার্টি তারা নিজস্ব জায়গা থেকে আন্দোলন করছে, বাসদ তাদের নিজস্ব জায়গা থেকে আন্দোলন করছে, জামায়াতে ইসলাম তারা নিজস্ব জায়গা থেকে আন্দোলন করছেৃ. এখন অনেক আরো অনেক দল যারা যুগপত আন্দোলনে নেই কিন্তু তারা আন্দোলন করছে আমরা সকলকে তাদের ওয়েলকাম জানিয়েছি।”
জাতিসংঘের শান্তিমিশনের বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রীর দেয়ার বক্তব্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘ আমরা মনে করি যে, পররাষ্ট্র মন্ত্রীর এই সমস্ত কথা বলে আন্দোলনকে ডাইভারশন করা, রাজনৈতিক সংকট থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে লাভ হবে না। এবার আমাদের লক্ষ্য স্থির, জনগনের লক্ষ্য স্থিরৃ এটাই আন্দোলনৃ এই অবৈধ সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে।”
‘সরকারই চায় ডানপন্থিদের উত্থান হোক’
ফ্রান্সের ঘটনাবলী ও ইউরোপের ডানপন্থিদের উত্থান সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘ যখনই গণতন্ত্র যদি ঠিক মতো চলতে না পারে তখনই এসব সমস্যা দেখা দেয়। পশ্চিমা বিশ্বকে ভিন্নভাবে দেখতে হবে, আমাদের দেশকে ভিন্নভাবে দেখতে হবে। কারণ পশ্চিমা বিশ্বে গণতন্ত্র ইন্সটিটিউশনালাইজৃ.। আমাদের এখানে সেটা নাই।”
‘‘ তারপরে যেটা এখানে যদি গণতন্ত্রকে স্পেস দেয়া না হয়,নির্বাচন যদি সুষ্ঠু না হয়, মানুষ যদি তার গণতান্ত্রিক অধিকার না পায় তাহলে স্বাভাবিকভাবে ডানপন্থি, উগ্রপন্থি, ফান্ডামেটালিজ, জঙ্গিবাদ এগুলোর উত্থান তো হবেই। সেকথাগুলো আমরা বার বার বলছি।”
তিনি বলেন, ‘‘ আজকে আন্তর্জাতিক বিশ্ব ও আমরা কেউই এখানে জঙ্গিবাদের উত্থান চাই না, আমরা কেউই এখানে ডানপন্থিদের চূড়ান্ত রুপের কাছে যেতে চাই না। ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধে যে মূল বিষয়টা ছিলো আমরা সত্যিকার অর্থেই উদারপন্থি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই।”
‘‘ সেটার পেছনে সবচেয়ে বড় বাধা গণতন্ত্রের স্পেস নেই। মানুষ যখন কোনো রাস্তা পাবে না, মানুষ যখন সরকার পরিবর্তনে যখন মানুষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোট দিয়ে পরিবর্তন করতে না পারবে তখন তো সে ভিন্ন দিকে যাবেই। সেই রাস্তায় তৈরি করে দিচ্ছে এই অবৈধ সরকার। তারা দেশে এমন একটা অবস্থা তৈরি করেছে যে, মনে হচ্ছে তারা একটা ডানপন্থি উত্থান হোক। তারা ঠেলে ওদিকে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করি, যারা আমরা গণতন্ত্রের বিশ্বাস করি তারা আমরা এখানে নিসন্দেহে জনগনকে সঙ্গে নিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই।”
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপন, সদস্য সচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, সদস্য শায়রুল কবির খান এবং সমাজ কল্যাণ সম্পাদক কামরুজ্জামান রতন উপস্থিত ছিলেন।