ঢাকা, শনিবার ২৭ই এপ্রিল ২০২৪ , বাংলা - 

জীবিত সিইসিকে প্রতীকী দাফন!

সোহেল সানি

2023-06-16, 12.00 AM
জীবিত সিইসিকে প্রতীকী দাফন!

পীর (ফার্সি অনুবাদ 'বয়োজ্যেষ্ঠ'‎) সূফি গুরু বা আধ্যাত্মিক শিক্ষকদের একটি উপাধি। তাদের হজরত (আরবি প্রতিবর্ণী. হাদরা‎ থেকে) এবং শাইখ বা শাইখ নামেও ডাকা হয়, যা মূলত এর আরবি প্রতিশব্দ। একে  ইংরেজীতে সেইন্ট বা সাধু এবং খ্রিস্টান পরিভাষা "এল্ডার" হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। গত ১২ জুন পর্যন্ত দেশ-বিদেশে বহুল আলোচিত ছিলো, বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন। কিন্তু ফলাফল ঘোষিত হওয়ার একটু আগে-পরে  আলোচনার শীর্ষে পৌঁছেন বরিশালের 'চরমোনাই পীর' বলে কথিত সৈয়দ ফয়জুল করিম। তিনি নির্বাচনে অর্ধলক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাতের কাছে হেরেছেন। তিনি ভোট অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে-পরে এমন কতগুলো কর্মকাণ্ডে সংঘটিত করেছেন, যা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যেও প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। তিনি গণমাধ্যম শুধু নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা সমালোচনার ঝড় তুলেছেন, জীবিত সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালকে ইন্তেকাল ঘোষণা করে তার প্রতীকী দাফন সম্পন্ন করে। যে কাজ কোরআন ও ইসলাম পরিপন্থী। এছাড়াও তিনি নির্বাচনে পরাজয়বরণ করার পরপরই বাংলার ভেনিস বলে খ্যাত  বরিশালকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, যা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনের চরম লংঘন এবং ঔদ্ধত্যপূর্ণ। কথিত চরমোনাই পীর ফয়জুল করিম ভোটারদের প্রভাবিত করার জন্য নির্বাচনী প্রচারাভিযানে নেমে প্রকাশ্যে বলেন,"খালেদা জিয়াকে ভোট দিলে ভোট পাবে বিএনপি, শেখ হাসিনাকে ভোট দিলে ভোট পাবে আওয়ামী লীগ, আর আমাকে ভোট দিলে ভোট পাবে আল্লাহর নবী" - নাউজুবিল্লাহ। এ বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জনমনকে কতটা বিষিয়ে তুলেছিলো, তা ফয়জুল করিমের প্রাপ্ত ভোটের দিকেই আঁচ করা যায়। "বাংলাদেশ থেকে বরিশালকে বিচ্ছিন্ন করে দেব"- মর্মেও একটি ঔদ্ধত্যমূলক ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ এর নেতা ফয়জুল করিম প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের ইন্তেকাল ঘোষণা করেন।  তার কৃত্রিম ডামি বা আকৃতিকে দেহের প্রতীকী রূপ দিয়ে দাফন-কাফন সম্পন্ন করেন। অর্থাৎ প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে কবরস্থ করেন। চরম জিঘাংসু পীর চরমোনাইর হাজার হাজার ধর্মান্ধ উৎসুক কথিত মুরিদরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ দাফনকাজে শরিক হয়। সাদা কাফন পরানো প্রতীকী লাশটি কবরে শায়িত করে মাটি দিয়ে ঢেকে দেয়ার দৃশ্যটি কেউ মোবাইলের  অডিও রেকর্ড অফ করে দেখলে, এটা বোঝার কোনো উপায়ই নেই যে এটা ফেক। মনে হবে সত্যিই বুঝি কোনো মৃত ব্যক্তিকেই সমাহিত করা হচ্ছে। আমি ভেবেছিলাম মৃত ব্যক্তিটি বুঝি পীর চরমোনাইয়ের ইসলামি আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় পর্যায়ের বিপুল জনপ্রিয় কোন নেতা। 

কিন্তু দৃশ্যটির অন্তর্নিহিত সারবস্তু বুঝতে পারি অডিওটি অন করার পর। আমি রীতিমতো তাজ্জববনে যাই। জুম করে দৃশ্যটি দেখতে গিয়ে দেখি কাফনের ওপরে মৃত্যু ব্যক্তির নামও রংতুলির আঁচরে অঙ্কিত করা হয়েছে। কী অদ্ভুত! পৃথিবীর ইতিহাসে কোন জীবিত ব্যক্তিকে মৃত ঘোষণা করে প্রতিকীরূপের কবর দেয়ার ঘটনা এটা'ই সম্ভবত প্রথম। এর আগে ফ্রান্স-বৃটিশ যুদ্ধে অস্পষ্ট ভুমিকার কারণে আমেরিকার কিছু প্রতিহিংসাপরায়ণ মানুষ নিজেদের প্রেসিডেন্ট ও জাতির পিতা জর্জ ওয়াশিংটনের মৃত্যু কামনা করে টোস্ট পান করে কুশপুত্তলিকা দাহ করেছিলো। এটি মার্কিনীদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসে একটি কলঙ্কের তিলক। 

যাহোক, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া চরমোনাইর কথিত পীরের ভিডিও ফুটেজে শুনলাম, গগনবিদারী কিছু শ্লোগানও। সেই শ্লোগান সিইসিকে প্রতীকী রূপে কবরস্থ করার সময়ে।  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে..। "এক-দুই-তিন-চার শেখ হাসিনা গদি ছাড়" মর্মে। 

শেখ হাসিনাকে অভিশাপও বর্ষণ করেন এই কথিত পীর ফয়জুল করিম। তিনি বলেন, 'হে আল্লাহ শেখ হাসিনার ওপর গজব নাজিল করো। শেখ হাসিনার পতন না ঘটা পর্যন্ত ঘরে ফিরবেন বলেও ঘোষণা দেন ফয়জুল করিম। তার এই জিঘাংসু আচরণ ভোট চলাকালীন অপরাহ্নে। ঠিক ওই সময় আমি সদর রোডে প্যানেল মেয়র ও চতুর্থবারের মতো বিজয়ী কাউন্সিলর গাজী মঈনুল হোসেন লিটুর সঙ্গে একটি ভোটকেন্দ্রের সামনে। এরই মধ্যে ফয়জুল করিমের সমর্থকদের সঙ্গে নৌকা সমর্থকদের সংঘর্ষের খবর শুনে সেখানে যাই। ওই ঘটনা মুহূর্তে   সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, একটি ভোট কেন্দ্রের সামনে চরমোনাই পীর ফয়জুল করিমের মৃদু দস্তাদস্তির দৃশ্য। দেখা যায়, তার নাশিকার বাম ফুটোতে একফোঁটা রক্তের চিহ্ন ও ঠোঁটের বামাংশটি কিঞ্চিৎ ফোলা। দৃশ্যটি দৃষ্টিগোচরিত হলে প্রতীয়মান হয় যে, দৌড়ঝাঁপ ও ধস্তাধস্তিতে একটুআধটু চোট লেগেছে। অথবা বাকবিতন্ডাকালীন প্রতিপক্ষের এমনকি তার সমর্থকদের মধ্যে কারো হাতের নখের আঁচড় বা ধস্তাধস্তি ও দৌড়ঝাঁপকালীন কারো হাতের মৃদু আঘাত। 

ঘটনাস্থলে উপস্থিত এক শিক্ষিত তরুণীর মোবাইলে ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ ও বক্তব্যে উঠে এসেছে ঘটনার মূল কারণ। ওই তরুণীর বক্তব্য সম্প্রচার করছে জাতীয় গণমাধ্যমগুলো। তরুণী দ্বিধাহীনকন্ঠে  সংঘটিত ঘটনার সূত্রপাত সম্পর্কে বলেছেন। তরুণীর মতে, নৌকা সমর্থক এক লোকের সঙ্গে মেয়র প্রার্থী ফয়জুল করিমের বাকবিতন্ডা লক্ষ্য করে তিনি মোবাইলে তা ধারণ করতে থাকেন একটু অদূরে দাঁড়িয়ে। তিনি দেখেন আওয়ামী লীগের লোকটাকে বগলচাপা দিলে ধস্তাধস্তি শুরু হতে। মুহূর্তে পীরের সমর্থকদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি ও দৌড়াদৌড়ি। এসময়  হাতপাখা সমর্থক পীরের এক মুরিদ  তরুণীর বুকে ঢুসা দেন, এবং গলায় ঝোলানো ব্যাজটি ফিতা থেকে পরে যায়। তরুণীটি দাবি করেছেন, তিনি স্থানীয় ওয়ার্ডের বাসিন্দা। কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। তিনি একজন নারীর উপর এরকম আচরণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার দাবি করে বলেছেন, "মেয়র হওয়ার আগেই একজন নারীর ওপর এরকম আচরণ করতে পারেন,  মেয়র হওয়ার পর কি করবেন?" 

এই ঘটনায় ভোটকেন্দ্রে আসা আরও একাধিক নারী-পুরুষেরও বক্তব্যে স্পষ্ট হয় যে, ইসলামি আন্দোলন অর্থাৎ হাতপাখার সমর্থকরা একটি ভয়ংকর পরিস্থিতির জন্ম দিতে চেয়েছিল। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, ঘটনাকালীন আওয়ামী লীগ সমর্থক ছিলো হাতেগোনা কয়েকজন। কিন্তু লাঠিসোটা হাতে ঘটনাত্তোর হাজার হাজার চরমোনাই পীর সমর্থকদের জঙ্গি মিছিলে প্রতীয়মাণ হয় যে, একটি বড় গন্ডগোল পাকাতে চেয়েছিলো, যাতে নির্বাচন কমিশন গোটা নির্বাচনই স্থগিত করতে বাধ্য হয়। এজন্যই দুপুরগড়ানো ওই অপ্রীতিকর ঘটনার পরেও মেয়র প্রার্থী ফয়জুল করিম ভোটগ্রহণের বিপক্ষে অবস্থান নেননি।  

কিন্তু আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটি এক্ষেত্রে বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়। তারা   কর্মীসমর্থকদের সতর্ক অবস্থায় রাখতে সমর্থ হন। এক্ষেত্রে  আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সচেতন ভুমিকার প্রশংসার দাবি রাখে।  লাঠিসোঁটা হাতে নিয়ে ইসলামি আন্দোলন জঙ্গি মিছিল করে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করতে চাইলেও কোন বাঁধার সম্মুখীন না হওয়ায় ব্যর্থ হয় তাদের পরিকল্পনা। 

তারপরও ভোটচলাকালীনই মেয়র প্রার্থী ফয়জুল করিম ক্ষিপ্র হয়ে গণমাধ্যমে যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যে ভাষা ব্যবহার করেছেন, তা একেবারেই অশোভন। "শেখ হাসিনার ওপর গজব পড়বে এবং সরকারের পতন ঘটিয়েই রাস্তা ছাড়বেন" - মর্মে ঘোষণা দিলেও 

কথিত পীর ফয়জুল করিম রাস্তা ছেড়ে চলে গিয়ে অন্য কর্মগুলো সম্পাদন করেন। ফয়জুল করিম সরকারের পতন না ঘটলে বরিশালকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন  করবেন। তবে কি তিনি বরিশালের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন?  আহাম্মক ছাড়া এমন ঘোষণা কেউ কী দিতে পারে? তার এ ঘোষণা সংবিধানের লংঘন। তার বিরুদ্ধে  রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে মামলা হওয়া উচিত। বিষয়টির প্রতি উচ্চ আদালতেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। 

আমরা অতীতে দেখেছি, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পূর্বপাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে সরাসরি বিচ্ছিন্ন করার কথা না বলেও শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী এবং বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ মাথায় চাপাতে হয়েছিলো। ফয়জুল করিমের মতো কথিত পীরের সঙ্গে উপরোক্ত নেতাদের তুলনা চলে না।

 

 কিন্তু দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য এসব ধর্মান্ধ গোষ্ঠী-দল তৎপর হয়ে উঠতে পারে। আগামী নির্বাচনকে ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য নানা অপচেষ্টায় যুক্ত হতে পারে এরা। আমরা হেফাজতের কথা ভুলে গেলে চলবে না। বরং সে কথা মাথায় রেখেই এই ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর যে কোন অপচেষ্টার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। বরিশালকে বাংলাদেশ থেকে আলাদা করার ঘোষণার প্রেক্ষিতে মনে করিয়ে দিচ্ছি অতীতের কিছু ঘটনাকে। 

১৯৫৪ সালে বরিশালেরই সন্তান শেরেবাংলা পূর্বপাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী  হয়েই গিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গে। তিনি অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কলকাতার মেয়র ছিলেন। সেই কলকাতা আর অখন্ড বাংলার রাজধানী নয়, পশ্চিম বাংলার রাজধানী। কলকাতায় নাগরিক সংবর্ধনা দেয়া হয় শেরেবাংলাকে।  অভিষিক্ত হয়ে তিনি আবেগভরাট কন্ঠে বলেন, "দুই বাংলা এক এবং অভিন্ন সত্তায় বাঁধা একে সীমানা প্রাচীর দিয়ে আলাদা করা যাবে না। 

 মুহূর্তে চরম প্রতিক্রিয়া। পশ্চিম পাকিস্তানে ডেকে পাঠানো হয় শেরেবাংলাকে। ক্ষমা প্রার্থনা করেও শেরেবাংলা মুখ্যমন্ত্রীত্ব ধরে রাখতে পারেননি। গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদের নির্দেশে কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী তাকে বরখাস্ত করেন দেশদ্রোহী ঘোষণা করে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদে সভাপতি (স্পিকার) ও গর্ভনর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর কাছে দাবি করেছিলেন, দেশ বিভাগের পর আর দ্বিজাতিতত্ত্বের দৃষ্টিভঙ্গিকে জিইয়ে না রেখে মুসলিম লীগের নাম থেকে "মুসলিম" শব্দটি পরিহার করে "জাতীয়তাবাদী লীগ" নামকরণ করা হোক। মুহূর্তে জ্বলে উঠেন পাকিস্তানের উজিরে আজম (প্রধানমন্ত্রী) নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান। তিনি সোহরাওয়ার্দীকে ভারতের লেলিয়ে দেয়া কুকুর বলে অভিহিত করে তার গণপরিষদের সদস্য পদই কেড়ে নেন। উল্লেখ্য অবিভক্ত বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীই  পাকিস্তান প্রস্তাব করেন। অপরদিকে ১৯৪০ সালে বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা একে ফজুলল হক নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কনভেনশনে "লাহোর প্রস্তাব" করেন ভারতের দুইকোনে দুটি নতুন রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা থেকে। কিন্তু ভারতের বাইরে  একাধিক রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব সংশোধন করে কেবল একটি রাষ্ট্র পাকিস্তান গঠনের প্রস্তাব পাস করা  হয় নিখিল ভারত মুসলিম লীগের দিল্লি কনভেনশনে।

মওলানা ভাসানী স্বাধীন পূরপাকিস্তান গঠনের ঘোষণা দিলে পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা তাকে গুলি করে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬২ সাল থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য ছাত্রলীগ নেতা সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদকে দিয়ে নিউক্লিয়াস গঠন করে গোপন তৎপরতা চালালেও সরাসরি বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার ঘোষণা থেকে বিরত ছিলেন, তারপরও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট লৌহমানব বলে খ্যাত আইয়ুব খান, জল্লাদ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তাকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলে বিচারের সম্মুখীন করেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ ও ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক নির্বাচনে ঐতিহাসিক ছয় দফার পক্ষে নিরঙ্কুশ রায় পাওয়ার পরও সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণাদান থেকে বিরত ছিলেন। অথচ, শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বাধীন যুবনেতৃত্ব  এবং নূরে আলম সিদ্দিকী, আসম আব্দুর রব, শাজাহান সিরাজ ও আব্দুল কুদ্দুস মাখনের নেতৃত্বাধীন ছাত্রনেতৃত্ব বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা ও সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করে স্বাধীনতার ইশতেহার প্রকাশ করে এবং বঙ্গবন্ধুর ওপর স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য পীড়াপীড়ি করে। কিন্তু অবিসংবাদিত নেতা কিন্তু সময়ক্ষেপণ করে মূলত স্বাধীনতা স্বাধীনতা ঘোষণার পথই প্রশস্ত করছিলেন। আসলে এটাকেই বলে  নিয়মাতান্ত্রিক রাজনীতির শিক্ষা, যা তিনি তার মহান নেতা সোহরাওয়ার্দীর কাছ থেকেই আত্মস্থ করেছিলেন।  তিনি বুঝতেন যে জনগণের অবিস্মরণীয় রায় পেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী হয়ে গোটা পাকিস্তান শাসন করার জন্য, পাকিস্তান ভেঙ্গে ফেলার জন্য নয়। এ কাজটি তখনই তিনি করতে পারেন, যদি পাকিস্তানের সামরিক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর না করে অন্যায়ভাবে যুদ্ধ চাপিয়ে দেন।  বিশ্বজনমত গঠনের বিষয়টি মাথায় রেখেই তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে ২৫ মার্চ পর্যন্ত আলোচনা চালিয়ে যান। অথচ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই ১ মার্চ থেকে দেশ পরিচালিত হচ্ছিল, কিন্তু তিনি হঠাৎ করে স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিলে গোটা বিশ্বের কাছে বিচ্ছিন্নবাদী হিসেবে অভিহিত হতেন এবং পাকিস্তান সরকারও তাকে কারাবন্দী করে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার সুযোগ হাতিয়ে নিতো। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ক্ষমতা হস্তান্তরে স্পষ্ট শর্ত দিয়ে " আমাদের এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম" মর্মে ঘোষণা দিলেও আলোচনা চালিয়ে যান, যাতে বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নবাদী নেতা হিসেবে অভিযুক্ত করতে না পারে। বঙ্গবন্ধুর এ কৌশল ছিলো, অপূর্ব এক দূরদর্শিতা। ঠিকই ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরু করলে গ্রেফতারের মূহুর্তে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বাংলাদেশের 

স্বাধীনতা অর্জনের পরেও অহেতুক মওলানা ভাসানী "নুসলিম বাংলা, সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টি " স্বাধীন পূর্ববাংলা, জাসদ সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মানের অহেতুক দাবি তুলে যুদ্ধ বিধস্ত বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করেন। তারা এ দাবি করলেও বাংলাদেশের কোন ভূখন্ডকে বিচ্ছিন্ন করার ঘোষণা দেননি। যা কথিত পীর ফয়জুল করিম দিলেন। 

তার জীবিত প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালকে ইন্তেকাল ঘোষণা করে কবর দেয়াকে কুরআন-সুন্নাহ কি বলে?  কোন মুসলমান কি কোন মুসলমানের প্রতি এরকম আচরণ করতে পারেন। ওয়াজ মাহফিলকারী  অনেক মওলানা অথবা পীর পদবীধারী চরমোনাইয়ের কথিত পীরের এহেন কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা করে ফয়জুল করিমকে, পাগল, উন্মাদ, টাউট ধর্মব্যবসায়ী বলে সমালোচনা করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ও গণমাধ্যমে। মেয়র পদে হারার পর 

ফয়জুল করিম বরিশালকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়ে গোটা বরিশালকে প্রশ্ন বিদ্ধ করে হেয়প্রতিপন্ন করেছেন। পর মেয়র হলে তিনি কি করতেন? জীবনে একটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর বা কোন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হওয়ার চেষ্টা করুন - তা অকৃতকার্য হবেন। মেয়র তো বড় বিষয়। ওটার কাছেদূরে স্বপ্ন দেখাও চরম ঔদ্ধত্যের। কেননা আপনি বরিশালকে অসম্মান করেছেন। বরিশাল আপনাকে ধারণ করবে না। বরং রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগে আপনাট স্থান হওয়া উচিত কারাগারে। এধরণের অপরাধে শাস্তি মৃত্যুদন্ড। আপনি নির্বাচনে হেরে জীবিত প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালকে ইন্তেকাল ঘোষণা করে কবরস্থ করার যে অইসলামিক কান্ড ঘটিয়েছেন এরও বিচার হওয়া হতো যদি দেশে শরিয়ত আইনী ব্যবস্থা থাকতো। 

এবারের বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোট চলাকালীনই শুধু নয়, ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে চরমোনাইর একটি ভোটকেন্দ্রে হামলা চালানো হয়  তৎকালীন বিএনপি প্রার্থী মজিবুর রহমান সরোয়ারের উপর। এই হামলায় সারোয়ারের দাঁত পড়ে যায়। প্রসঙ্গত মজিবুর রহমান সরোয়ার বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র।  অভিযোগ রয়েছে চরমোনাই ইউনিয়নের ডিঙ্গামানিক গ্রামের খসরুকে মাদ্রাসায় ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়। জমি সংক্রান্ত মামলার জের ধরে ওই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করা হয়। সেই হত্যা মামলায় বর্তমান কথিত পীর ফয়জুল করিমের পিতা মরহুম সৈয়দ ফজলুল করিম আসামি ছিলেন। নিজ ভিটেবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করার বাধা দিতে গিয়ে প্রতিবেশী হালিম খন্দকারের হাত-পা ভেঙ্গে দেয়া হয়। কেেয়ক মাস আগে বজলু হাওলাদারকে হাত-পা ভেঙ্গে দেয় ফয়জুল করিমের লোকেরা। ৩০ কমিটি নামে তার একটি সন্ত্রাসী বাহিনী আছে। যাদের ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত থাকে স্থানীয়রা। 

ফয়জুল করিমের পিতা সৈয়দ ফজলুল করিমের দুই বিয়ে। প্রথম ঘরের সন্তান মাওলানা মোস্তাক ও মাওলানা মাদানি পিতার সমস্ত বিষয়সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। দ্বিতীয় ঘরের সন্তান ফয়জুল করিম, রেজাউল করিম, জিয়াউল করিম, আবুল খায়ের করিম ও নূরুল করিম।

ফয়জুল করিমের দাদা মরহুম মাওলানা এছাহাকেরও দুই পতœী ছিলেন। দ্বিতীয় পতœীর সন্তানরাও সম্পত্তির অংশীদার হতে পারেনি। 

 ফয়জুল করিমের একাধিক ব্রিকফিল্ড ব্যবসা রয়েছে। বেকু মেশিন দিয়ে পরের জমির মাটি কেটে নিতে গিয়ে স্থানীয় মহিলাদের ঝাড়ুর মিছিলের সম্মুখীন হম। চরপত্তনিয়া বিশ্বাসের হাটবাজারের পূর্বপাশের অন্যের জমিতে ব্রিকফিল্ড বসানোর চেষ্টা করূ হলে আদালতের নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েন। উপর্যুক্ত অভিযোগ সম্বলিত একটি লিফলেট পাওয়া যায় বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে। বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে পর্যবেক্ষণ করতে গেলে যা আমারও হস্তগত হয়। 

এবার দৃষ্টি ফেরাতে চাই পবিত্র কোরআন ও ইসলাম মানুষের মৃত্যু সম্পর্কে কী বলেছে -সেদিকে। মৃত্যু হচ্ছে, জাগতিক দেহ হতে আত্মার পৃথকীকরণ। অর্থাৎ জাগতিক জীবনের সমাপ্তি। একইসঙ্গে আত্মার জাগতিক দুনিয়া হতে আখিরাতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা। সর্বোপরি মৃত্যু হচ্ছে চলমান জীবন প্রক্রিয়ার একটি পরিবর্তনীয় অবস্থা। ইসলামি পরিভাষায় সকল জীবিত প্রাণীর জন্যই মৃত্যু একটি সর্বোচ্চ ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। মৃত্যুর ফেরেশতা মালাক উল মউত আজরাইল মৃত ব্যক্তির রুহ অর্থাৎ আত্মা শরীর হতে বের করে নেন এবং তাঁর সঙ্গে থাকেন অন্যান্য ফেরেশতাও। মৃত ব্যক্তির জাগতিক জীবনাচারের উপর ভিত্তি করে মৃত্যুর আয়োজন করা হয়। মৃত্যু ব্যক্তির শেষকৃত্য সম্পাদনার পর তার কাছে মুনকার ও নকীর নামক নীল চোখ এবং কালো গাত্রবর্ণ বিশিষ্ট দুজন প্রশ্নকারী ফেরেশতার আগমন ঘটে। তাঁরা মৃত ব্যক্তির ঈমান তথা বিশ্বাস পরীক্ষার জন্য তাকে প্রশ্ন করতে থাকেন। সৎ ঈমানদার ব্যক্তি প্রশ্নের সঠিক জবাব প্রদান করতে পারবেন এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনে শান্তিতে থাকবেন। আর অসৎ অবিশ্বাসী ব্যক্তি প্রশ্নের জবাব দিতে পারবেন না। ফলে ফেরেশতারাই তার জন্য কঠিন শাস্তির আয়োজন করবেন। হত্যা বা  আত্মহত্যা অত্যন্ত ঘৃণিত এবং কবিরা গুণাহ বা বড় অপরাধ। মানুষের মৃত্যু হতে কিয়ামত বা পুনরুত্থান পর্যন্ত সময়কে ইসলামি পরিভাষায় 'বারযাখ' বলা হয়। এটি কিয়ামত ও দুনিয়ার জীবনের মধ্যবর্তী পর্দা স্বরূপ। মানুষের মৃত্যুর পর এ জীবনের শুরু হয়। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, "আর তাদের সামনে রয়েছে 'বারযাখ', যা পুনরুত্থান পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে-"(সুরা মুমিনুন;১০০)

বারযাখ হলো কবরের জীবন। এটি আখিরাতের প্রথম পর্যায়। কিয়ামত অর্থ দন্ডায়মান হওয়া বা উঠা। কবর হতে মানুষ উঠে সেদিন আল্লাহর সামনে দন্ডায়মান হবে, তাই একে কিয়ামত বলা হয়। 

জানাযা একটি বিশেষ প্রার্থনা যা কোনো মৃত মুসলমানকে কবর দেয়ার পূর্বে সংগঠিত হয়। এটি ফরজে কেফায়া বা সমাজের জন্য আবশ্যকীয়। কোনো মুসলমানের মৃত্যু হলে মুসলমান সম্প্রদায়ের পক্ষ হতে অবশ্যই জানাযার নামাজ আদায় করতে হবে। অংশগ্রহণকারীরা বেজোড় সংখ্যক কাতারে বা সারিতে দাঁড়িয়ে একজন ইমামের নেতৃত্বে এ নামায আদায় করেন। জানাযা শেষে মোনাজাত বা দোয়া প্রার্থনা করতে হয় না। কারণ নামাযের মাধ্যমেই মৃতের জন্য দোয়া আদায় হয়ে যায়। জানাযা শেষে অবিলম্বে মৃত ব্যক্তিকে কবর তৈরি করে মাটিতে দাফন করতে হয়। কবরে দাফনের আগে মৃত ব্যক্তির কাফন মোড়ানো দেহ সম্মুখে রেখে জানাজার নামায পড়াই ইসলামের বিধান। যার জানাজা পড়া হয়নি, কেবল তার ক্ষেত্র ব্যতীত অন্য কারো গায়েবানা জানাজা পড়া  শরিয়তসম্মত নয়। কেউ যদি কাফের রাষ্ট্রে মৃত্যবরণ করে এবং তার জানাজা পড়া না হয়, তাহলে তার গায়েবানা জানাজা পড়া আবশ্যক। কিন্তু যদি তার জানাজার নামায একবার হয়ে থাকে তাহলে তার গায়েবানা জানাজা হবে না। বাদশা নাজাশি ছাড়া অন্য কারো গায়েবানা জানাজার কথা হাদীসে নেই। রাসূল সল্লাল্লাহু ওয়াসাল্লাম মদীনাতে তার গায়েবানা জানাজা আদায় করেছিলেন। কিন্তু তার জীবদ্দশায় অনেকে মৃত্যুবরণ করলেও গায়েবানা জানাজা আদায় করেছিলেন এমন কোন তথ্য নেই। 

প্রশ্ন: পীর কাকে বলে? ইসলামে পীর মুরিদের কোন স্থান আছে কি?

পবিত্র কুরআনের যে আয়াত গুলোর অপব্যাখ্যা করে প্রচলিত পীর তাদের বিনা পুঁজির ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছে আজ সেই সংশয় নিরসন করব ইন শাহ্ আল্লাহ। ইসলাম মহান আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত একমাত্র পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। যা মেনে চলা সমগ্র মানব জাতির উপর ফরয। আল্লাহ যেমন এর বিধান নাযিল করেছেন, তেমনি তা বাস্তবে রূপদানের জন্য রাসূলকে আমাদের মাঝে প্রেরণ করেছেন। তাঁর জীবদ্দশায়ই ইসলাম পূর্ণতা লাভ করেছে। তিনি ১০ম হিজরীর ৯ই যিলহজ্জে আরাফার ময়দানে সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে যখন বিদায় হজ্জ পালন করেছিলেন তখন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামত সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম-' (মায়েদা ৫/৩)। রাসূল বলেন,، ‘আমি তোমাদ

দ্বীনের উপর ছেড়ে গেলাম। যার রাতটাও দিনের মত (উজ্জ্বল)। ধ্বংসশীল ব্যক্তি ছাড়া আর কেউই তা থেকে সরে আসতে পারে না।’ (ইবনু মাজাহ হা/৪৩)। 

এই পৃথিবীর বুকে একমাত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তির প্রতিটি কথা ও কাজের অনুসরণ করা আবশ্যকীয় নয়, সে যেই হোকনা কেন। একদা ইমাম মালেক (রহঃ) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ক্ববরের দিকে ইশারা করে বলেন, ‘এ ক্ববরের অধিবাসী ব্যতীত পৃথিবীর সকল ব্যক্তির কথা গ্রহণীয় ও বর্জনীয়। অর্থাৎ শুধুমাত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতিটি কথাই গ্রহণীয়। পীর কাকে বলে? ইসলামে পীরের বিধান কী? পীর’ শব্দটি ফারসী শব্দ। এর অর্থ বয়োজ্যেষ্ঠ মুরুব্বী, ইত্যাদি। ব্যবহারিক ভাবে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা পুংলিঙ্গ বা স্ত্রীলিঙ্গ উভয়কেই ‘পীর’ বলা হয়। মূলত সূফীবাদী বা তাসাওউফ পন্থীদের গুরুকে ‘পীর’ নামে অভিহিত করা হয়। (পীরবাদের বেড়াজালে ইসলাম, পৃ. ৩৬)। তৃতীয় শতাব্দী হিজরীতে গ্রীক, পারসিক ও হিন্দু সভ্যতার সংমিশ্রণে পীর-মুরীদী প্রথার উৎপত্তি হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমরা একসময় তাদের ধর্মীয় দিক-নির্দেশনা প্রদানকারী ব্যক্তিকে ‘পীর’ নামে অভিহিত করতো। যা এখনো বহু জায়গায় প্রচলিত আছে। ১৯৮১ সালের সরকারী হিসাব মতে এদেশে প্রায় দুই লক্ষ আটানব্বই হাজার ‘পীর’ রয়েছে। যেমন, দেওয়ানবাগী, কুতুববাগী, রাজারবাগী, সুরেশ্বরী, ফরীদপুরী আটরশি, সায়েদাবাদী, নেছারাবাদী,  এনায়েতপুরী, চন্দ্রপুরী, কামাল্লার ভন্ডপীর, মাইজভান্ডারী, কেল্লাবাবা, খাজাবাবা, রেজভী, লেংটা বাবা, তালা বাবা, শিকল বাবা ইত্যাদি এমন আরো বিভিন্ন নামে পীর রয়েছে। অবশ্য এই দেশে তথা ভারতীয় উপমহাদেশে বহু সুফীসাধক ইসলাম প্রচারক হিসেবে এসেছিলেন। সেই তাদের সঙ্গে বর্তমান কথিত পীরদের তুলনা করা সমীচীন নয়। বর্তমান কথিত পীরেরা আল্লাহ ও বান্দার মাঝে ‘অসীলা’ হিসাবে পূজিত হচ্ছে ধর্মান্ধদের দ্বারা। তারা নিজেদের তৈরি বিভিন্ন জঘন্য বুলি, নিয়ম-নীতি ও নোংরা দর্শনের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে যেমন ধোঁকা দিচ্ছেন, তেমনি ভ্রান্তিতে নিপতিত করে পকেট সাফ করছে। জীবিত হৌক বা মৃত হৌক তাদের সন্তুষ্টির উপরে মুরীদের ইহকালীন মঙ্গল ও পরকালীন মুক্তি নির্ভর করে বলে ব্যাপকভাবে ধারণা প্রচলিত রয়েছে। এদের মতে পীরকে কামনা করা আল্লাহকে কামনা করার শামিল (নাঊযুবিল্লাহ)। অথচ ইসলামী শরী‘আতে পীর ধরা বা মুরীদ হওয়া সম্পূর্ণ নাজায়েয কাজ। কারণ রাসূলুল্লাহ সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈ এমনকি তাবে-তাবেঈনের যুগে পীর-মুরীদীর কোনো অস্তিত্ব ছিল না। মানুষ মূলতঃ পরকালে মুক্তির অসীলা হিসাবে পীর ধরে থাকে এ বিশ্বাসে যে, তারা তাদের জন্য আল্লাহর নিকটে সুফারিশ করবে (সূরা যুমার ৩)। যে ব্যক্তি এরূপ বিশ্বাস করবে, সে বড় শিরকে লিপ্ত হবে, যা মানুষকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয় ও তার সমস্ত নেক আমল বরবাদ হয়ে যায় (সূরা যুমার ৬৫) কেননা মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলুল্লাহ কোনো পীরের অনুসরণ করার নির্দেশ দেননি। বরং মহান আল্লাহ তার ‘অসীলা’ তথা নৈকট্য অন্বেষণ করতে বলেছেন (আল-মায়েদাহ, ৫/৩৫)। 

পীরবাদের সবচেয়ে বড় ক্ষতি এই যে, তারা মানুষকে কুরআন-হাদীস থেকে মুখ ফিরিয়ে পীরের ধ্যানে মগ্ন রাখেন। পীরের কথিত কাশফ ও কেরামত এবং ভিত্তিহীন অলীক কল্পকাহিনী সমূহ এদের নিকট প্রধান দলীল হিসাবে গণ্য হয়। যুগে যুগে মানুষকে ধর্মের নামে শিরকে লিপ্ত করেছে এই শ্রেণীর লোকেরা। অথচ কাশফ ও কেরামত ইসলামী শরী‘আতের কোন দলীল নয়। সুতরাং এসব দল থেকে মানুষকে দূরে রাখার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো আবশ্যক। লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস গবেষক।