অষ্টম জাতীয় পে-স্কেল কার্যকর হয়েছে ২০১৫ সালে। এর পর পেরিয়ে গেছে আট বছর। এর মধ্যে সব ধরনের দ্রব্যের মূল্য অনেক অনেক বেড়ে গেছে। অথচ এই দীর্ঘ সময়েও নতুন পে-স্কেল করতে সরকারের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলে বহুবার ধরনা দিয়েও ফল আসেনি। এতে করে হতাশ সরকারি কর্মচারীরা; নতুন পে-স্কেলের দাবিতে একাট্টা হয়েছে তাদের সব সংগঠন। পে-স্কেলসহ সাত দফা দাবিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ২৬ মে মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে সংগঠনগুলো।দুই দফায় তারিখ পরিবর্তন হলেও কর্মসূচি পালনে অনড় সরকারি কর্মচারীরা। এদিকে তাদের কর্মসূচিতে সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে প্রশাসনের শীর্ষ মহলের। নবম পে-স্কেল বাস্তবায়নসহ সাত দফা দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী দাবি আদায় ঐক্য পরিষদ। তাদের দাবির সঙ্গে একাট্টা বাংলাদেশ বিচার বিভাগীয় কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশন, ১১-২০ গ্রেডের সরকারি চাকরিজীবীদের সম্মিলিত অধিকার আদায় ফোরাম, বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি এবং তৃতীয় শ্রেণি সরকারি কর্মচারী সমিতি। সরাসরি কর্মসূচিতে না এলেও দাবির সঙ্গে একমত সরকারি কর্মচারীদের অন্যান্য সংগঠনও।
তাদের দাবিগুলো হলো পে-কমিশন গঠনের মাধ্যমে নবম পে-স্কেল বাস্তবায়ন, পে-স্কেল বাস্তবায়নের আগে অন্তর্র্বতীকালীন কর্মচারীদের জন্য ৫০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা প্রদান, বঙ্গবন্ধুর ১৯৭৩ সালের ঘোষণা অনুযায়ীÑ ১০ ধাপে বেতন স্কেল নির্ধারণসহ পে-কমিশনে কর্মচারী প্রতিনিধি রাখা, সচিবালয়ের মতো সব দপ্তর, অধিদপ্তরের পদনাম পরিবর্তনসহ ১০ম গ্রেডে উন্নীতকরণ এবং এক ও অভিন্ন নিয়োগবিধি প্রণয়ন করা, টাইম স্কেল সিলেকশন গ্রেড পুনর্বহালসহ বেতন জ্যেষ্ঠতা পুনর্বহাল, বিদ্যমান গ্র্যাচুইটি বা আনুতোষিকের হার ৯০ শতাংশের স্থলে ১০০ শতাংশ নির্ধারণ ও পেনশন গ্র্যাচুইটি ১ টাকার সমান ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের আপিল বিভাগের রায় বাস্তবায়নসহ সহকারী শিক্ষকদের বেতন নিয়োগ বিধি ২০১৯ এর ভিত্তিতে ১০ম গ্রেডে উন্নীতকরণ ও অধঃস্তন আদালতের কর্মচারীদের বিচার বিভাগীয় সহায়ক কর্মচারী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা, আউটসোর্সিং পদ্ধতি বাতিলপূর্বক ওই পদ্ধতিতে নিয়োগকৃত ও উন্নয়ন খাতের কর্মচারীদের রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করা, ব্লক পোস্টে কর্মরত কর্মচারীসহ সব পদে কর্মরতদের পদোন্নতি বা ৫ বছর পর পর বেতন স্কেলের উচ্চতর গ্রেড দেওয়া, বাজারমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধির সঙ্গে সমন্বয়পূর্বক সব ভাতাদি পুনর্র্নিধারণ করা, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর ও অবসরের বয়স সীমা ৬২ বছর নির্ধারণ করা।
এসব দাবির বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী দাবি আদায় ঐক্য পরিষদের মুখ্য সমন্বয়ক মো. ওয়ারেছ আলী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় বৈষম্য মেনে নেওয়া যায় না। দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতি ও পরিবারের ভরণপোষণের ব্যয়ভার প্রাপ্ত বেতনে ১৫ দিনও বহন করা সম্ভব হয় না। ৫ বছর পর পর পে-স্কেল দেওয়ার প্রথা চালু থাকলেও ২০১৫ সালে ৮ম পে-স্কেল দেওয়ার পর দীর্ঘ সাত বছর পেরিয়ে আট বছরে পড়ছে ৯ম পে-স্কেল বাস্তবায়ন হয়নি।
অনতিবিলম্বে সব দপ্তর-অধিদপ্তরের কর্মচারীদের পদনাম পরিবর্তন করে বেতন ও পদবি বৈষম্য দূর করে আগের মতো টাইম স্কেল, সিলেকশন গ্রেড পুনর্বহালসহ এক ও অভিন্ন নিয়োগ বিধি বাস্তবায়ন করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর আশু হস্তক্ষেপ কামনা করে সংগঠনের মুখ্য সমন্বয়ক আরও বলেন, দাবি পূরণ না হলে আগামী ১২ মে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মহাসমাবেশ করবে সরকারি কর্মচারীরা।
বাংলাদেশ প্রশাসনিক কর্মকর্তা বাস্তবায়ন ঐক্য পরিষদের মহাসচিব আবু নাসের খান বলেন, ২০১৫ থেকে ২০২৩ এর মধ্যে সেবা ও দ্রব্যাদির মূল্য অনেক বেড়েছে। ৮ম পে-স্কেল দিয়ে বর্তমানে সংসার চালানো বেশ জটিল। তাই সবাই একমত হবে যে, ৯ম পে-স্কেল এখনই ঘোষণা হওয়া দরকার। পে-স্কেল ঘোষণার আগে সরকারের নৈতিকভাবে এটা মাথায় রাখা উচিত যে, সেটি যেন আমাদের কাজে আসে। বেতন বৈষম্য কমানো উচিত। সাম্য শুধু কথায় নয়, বাস্তবেও দেখানো উচিত।
সরকারের এ অবস্থানে হতাশ বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. আনোয়ারুল ইসলাম তোতা বলেন, ২০০৫ সালের পর ২০০৯ সালে ৭ম জাতীয় পে-স্কেল কার্যকর করা হয়। পরিস্থিতি বিবেচনায় এটা করা হয়েছিল। মূলত এই সময়টাতে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পায়। সেই পে-স্কেলটি হয় চার বছর পরে। ২০০৯ সালের পর ২০১৫ সালে ৮ম জাতীয় পে-স্কেল হয়। তার মানে ৬ বছর পরে পে-স্কেলটি হয়। ২০১৫ থেকে ২০২৩ এ যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি দ্রব্যমূল্য বেড়েছে এবং তা চলমান রয়েছে।
১১-২০ গ্রেডের সরকারি চাকরিজীবীদের সম্মিলিত অধিকার আদায় ফোরামের সভাপতি মো. লুৎফুর রহমান বলেন, একটি পে-স্কেল থেকে আরেকটি পে-স্কেলের মধ্যকার সময়ে যাতে বাজারমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে বেতনের সমান্তরাল সম্পর্ক থাকে, তার জন্য ইনক্রিমেন্ট দিয়ে থাকে সরকার। কিন্তু এই ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট কি আসলেই যথেষ্ট? দুই পে-স্কেলের মধ্যকার সময়ে সেবা ও দ্রব্যাদির মূল্যবৃদ্ধি পেয়ে থাকে কয়েকবার, যা ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট দিয়ে সামাল দেওয়া সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ বিচার বিভাগীয় কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহ মো. মামুন বলেন, বেদনাদায়ক বিষয় হচ্ছেÑ নতুন পে-স্কেলের গন্ধ পেলেই এই দেশে সব কিছুর দাম বেড়ে যায় আগেই। আবার যখন পে-স্কেল ঘোষণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আরেক দফায় বেড়ে যায় দ্রব্যমূল্য। ফলে পে-স্কেল পেলেও শুরুতেই টানাটানিতে পড়তে হয় বেতনভোগীদের। তাই পূর্বের ন্যায় পে-স্কেলের পেছনেই পড়ে থাকতে হয়। যারা উচ্চ ধাপে বেতন পায় তাদের চললেও নি¤œধাপে বেতনভোগীদের দিন কাটে কষ্টে।