মেট্রোরেল মানেই জাপান- এই ধারা থেকে বের হয়ে আসছে সরকার। একক দেশ হিসেবে জাপানের ঋণে তিনটি মেট্রোরেল করায় তাদের সঙ্গে দর-কষাকষির সুযোগও কমে গেছে। দেশটি যা খরচ ধরছে, তাই মেনে নিতে হচ্ছে সরকারকে। এজন্য প্রতিযোগিতা বাড়াতে জাপানের বাইরে বিকল্প পথে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তাই এবার মেট্রোরেল লাইন-৫ প্রকল্পে অর্থায়ন করবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। জাপানের তুলনায় এডিবি থেকে ঋণ নিলে মেট্রোরেলের খরচও পড়বে কম। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্যই জানা গেছে।টেকনিক্যাল অ্যাসিসটেন্স ফর ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট লাইন-৫ সাউদার্ন রুট সমীক্ষা প্রকল্পের আওতায় ১৭ দশমিক ২০ কিলোমিটার মেট্রোরেলের প্রাক সম্ভাব্য সমীক্ষা প্রায় শেষ পর্যায়ে। ২০৩০ সালের মধ্যে গাবতলী থেকে আফতাবনগর পশ্চিম পর্যন্ত ১৩ দশমিক ১০ কিলোমিটার পাতাল এবং আফতাবনগর সেন্টার থেকে দাশেরকান্দি পর্যন্ত ৪ দশমিক ১০ কিলোমিটার উড়াল মোট ১৭ দশমিক ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেল নির্মাণ করা হবে। ১৫টি স্টেশন (পাতাল ১১টি এবং উড়াল ৪টি) বিশিষ্ট মেট্রোরেল নির্মাণের জন্য প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন হয়েছে।২০২১ সালের ২১ এপ্রিল নিয়োজিত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করেছে। ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি ২০২২ সালের ৩০ নভেম্বর শেষ হয়েছে। ২০২৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি এ ড্রাফট ফাইনাল ডিটেইলড নকশা দাখিল করেছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। ইঞ্জিনিয়ারিং নকশা কাজের অগ্রগতি ৯২ শতাংশ। ফিজিবিলিটি স্ট্যাডির ভিত্তিতে বিনিয়োগ প্রকল্পের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) ২০২৩ সালের ২২ মার্চ সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে পাঠানো হয়েছে।
এ প্রকল্পের প্রাথমিক নির্মাণ ব্যয় ৪৮ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে ৩১ হাজার কোটি টাকা ঋণ আসবে এডিবি থেকে। ২০৩০ সালের মধ্যে রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশ মিলিয়ে ছয় রুটে চলবে মেট্রোরেল। এরই মধ্যে লাইন সিক্সের আওতায় শেষের পথে উত্তরা থেকে মতিঝিল অংশের কাজ। ছয়টি রুটের মধ্যে পাঁচটি রুটেই ঋণ দেবে জাইকা। অথচ রুট-৫ এ ঋণ দেবে এডিবি।জাপানের হাত ধরে প্রথম মেট্রোরেলের যুগে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। উত্তরা থেকে কমলাপুর লাইন-৬ এ অর্থায়ন করছে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থা (জাইকা)। চলমান এমআরটি ১ ও ৫-এ দুটি প্রকল্পেও আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে দেশটি। প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল ওহাব বলেন, ঢাকায় ছয়টি মেট্রোরেল রুট নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে পাঁচটিতে ঋণ দিচ্ছে জাইকা। তবে আমাদের প্রকল্পে বিশাল অঙ্কের ঋণ দেবে এডিবি। প্রকল্পের মোট খরচ হবে ৪৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩১ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেবে এডিবি। প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি কাজ শেষ হয়েছে। নানা কারণে ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি কাজেও কিছুটা ব্যয় বাড়ছে। এই কাজেও অনুদান দিয়েছে এডিবি। আমরা মূল প্রজক্টের ডিপিপি কাজ শেষ পর্যায়ে এনেছি। এটা একনেক সভায় পাস হলেই ভূমি অধিগ্রহণসহ অন্য কাজ শুরু করে দেব।ডিএমটিসিএল জানায়, সমীক্ষা কাজে ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৪১১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এরই মধ্যে প্রকল্পের প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)।কারিগরি সহায়তা প্রকল্পটি মোট ৪০৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ব্যয়ে জানুয়ারি ২০২০ থেকে জুন ২০২৩ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ৬ ডিসেম্বর ২০১৯ সালে অনুমোদন করেছিলেন। বর্তমানে প্রকল্পের কতিপয় নতুন খাতের অন্তর্ভুক্তি, বিভিন্ন খাতের পরিমাণ ও ব্যয় কম বেশি হওয়ায় মোট ৪১১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হচ্ছে। জানুয়ারি ২০২০ থেকে জুন ২০২৪ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য সংশোধিত কারিগরি প্রকল্প প্রস্তাবটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। সমীক্ষা কাজেও ২৮১ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে এডিবি।ডিএমটিসিএল জানায়, ১৭ দশমিক ২০ কিলোমিটার এমআরটি লাইন-৫ (সাউদার্ন রুট) নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে পাতাল ১৩ দশমিক ১০ কিলোমিটার ও উড়াল ৪ দশমিক ১০ কিলোমিটার। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত একটি প্রাক-সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়। প্রকল্পের ইঞ্জিনিয়ারিং সেবার জন্য এডিবির সঙ্গে ২০১৯ সালে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। করোনার জন্য কিছুটা দেরিতে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, বিস্তারিত নকশা ও দরপত্র সহায়তা সংক্রান্ত বিষয়ে মার্চ ২০২১ এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরে এপ্রিল ২০২১ এ পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। এরইমধ্যে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে এবং ডিটেইল্ড ডিজাইন ৭ এপ্রিল ২০২৩ তারিখের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। পরে এপ্রিল ২০২৩ থেকে এপ্রিল ২০২৪ পর্যন্ত দরপত্র সহায়তা নেওয়া হবে। প্রস্তাবিত প্রকল্পটির ক্রমপুঞ্জিত আর্থিক অগ্রগতি ৫১ দশমিক ৩৯ শতাংশ।প্রকল্পের মূল টিএপিপির (টেকনিক্যাল অ্যাসিস্টেন্স প্রজেক্ট প্রপোজাল) যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়বাবদ কোনো খাত অন্তর্ভুক্ত ছিল না। পরে যে সব কর্মকর্তা সরকারি ঋণ সুবিধার বিপরীতে যানবাহন কিনেছেন তাদের যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বাবদ ২০০ জনমাস চাহিদা সংশোধিত টিএপিপিতে প্রস্তাব করা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের ৮৬ নম্বর স্মারকের মাধ্যমে সংশোধিত টিএপিপিতে অন্তর্ভুক্তির শর্তে যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বাবদ ১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
এছাড়া মূল টিএপিপিতে নিয়োগ পরীক্ষার ব্যয় বাবদ কোনো খাত অন্তর্ভুক্ত ছিল না। কিন্তু টিএপিপি অনুযায়ী ১৪তম গ্রেড থেকে ৯ম গ্রেড পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে ডিএমটিসিএল’র তহবিল থেকে অর্থ ধার করে নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন করা হচ্ছে। অর্থ ফেরত দেওয়ার লক্ষ্যে নিয়োগ পরীক্ষা ব্যয় বা খাত অন্তর্ভুক্তির জন্য ২৫ লাখ টাকা প্রয়োজন।সংশ্লিষ্ট অংশীজন, ডিজাইন ও কারিগরি প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং উপকারভোগীদের নিয়ে কর্মশালা ও সেমিনার আয়োজনের লক্ষ্যে ওয়ার্কশপ/সেমিনার/কনফারেন্স খাতে ৩০ লাখ টাকা এবং আপ্যায়ন খাতে অতিরিক্ত দুই লাখ টাকা প্রয়োজন। মূল টিএপিপিতে মোবাইল ফোন, টিঅ্যান্ডটি ফোন, ইন্টারনেট ও অন্য খাতে ৩২ লাখ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় বাড়ি ভাড়া খাতে যে বরাদ্দ ধরা হয়েছিল তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল হওয়ায় ওই খাতে অতিরিক্ত ১ কোটি ৯১ লাখ টাকার প্রয়োজন। কোভিডজনিত কারণে চুক্তি স্বাক্ষরে দেরি হওয়ায় প্রকল্পটির বাস্তবায়ন মেয়াদকাল এক বছর অর্থাৎ ৩০ জুন ২০২৪ পর্যন্ত বাড়ানো প্রয়োজন।
ডিএমটিসিএল জানায়, এর আগে এডিবি থেকে প্রকল্পটির প্রি-ফিজিবিলিটি স্টাডি শেষ করা হয়। বর্তমান টিএ প্রকল্পের আওতায় স্থানীয়ভাবে ৯ মাস ব্যাপী সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়। প্রাথমিকভাবে এমআরটি লাইন-৫ নর্থ ও সাউথ দুটি লাইনের শুরুতেই গাবতলীতে স্টেশন স্থাপনের পরিকল্পনা ছিল। পরে এমআরটি লাইন-৫ নর্থ এর সমীক্ষা অনুযায়ী প্রথম স্টেশনটি গাবতলী থেকে হেমায়েতপুরে স্থানান্তরিত হয়। ফলে গাবতলীতে প্রধান সড়ক বরাবর নর্থ লাইনের স্টেশন থেকে দক্ষিণ পাশে সাউথ লাইনের স্টেশন নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয় এবং স্টেশন দুটি ১২০ মিটার আন্ডারগ্রাউন্ড ট্যানেলের মাধ্যমে সংযুক্ত রাখার সিদ্ধান্ত হয়।