ধর্মসাগরকে কেন্দ্র করে আমরা যারা বড় হয়েছি। প্রেমহীন উচ্চমাধ্যমিকে ধর্মবাণিক্যের দিঘিটা কী দিয়েছে? সেই হিসাব অক্ষরের চেয়ে বোধহয় স্নায়ুর পুকুরে এক আশ্চর্য রাজহাঁস। হলুদ বিকেলে কাঁঠালীচাঁপার মৌতাতে—যখন শহরের অনঙ্গবালারা হেঁটে যেত। রূপবৈচিত্র্যর সমারোহে আমাদের খুনি হতে ইচ্ছে করত। সেই খুন অবশ্য অস্ত্রের নয় মন্ত্রের।
ভীমের গদার আঘাত হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে দুর্যোধন। গদ্যও কিন্তু গদা। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যেন ভীম। কালো ফ্রেমের চশমা, পাইপ টানা, রাশভারী লোকটা তাঁর ‘প্রেমের গপ্পো’তে একটা মেয়ে চরিত্রের টিটকারি নাম রাখেন ‘হিপ হিপ হুররে’। ভারী নিতম্বের জন্যই বোধহয় এই নাম। মেয়েটা একদিন সহপাঠি ছুকরা গ্রুপকে বলেই ফেলে, ‘আপনাদের মা বোন নেই?’ পোলাপাইনেরও উত্তর রেডি করা ছিল, ‘আছে, কিন্তু বাপেরা আর দুলাভায়েরা সেইগুলি দখল কইরা রাখছে।’
আমাদের বন্ধু সৌরভের এরকম একটা ঘটনা ঘটেছিল। তখন সন্ধ্যার পর ধর্মসাগরের গোত্তা খাওয়া বাতাস না-খেলে আমাদের পেটের ভাত হজম হতো না। ধর্মসাগর পেড়িয়ে ঝাউতলার দিকে ওর একটা টিউশনি ছিল। ও আড্ডায় বলেছিল, পুরাতন পৌরসভার গলি দিয়ে ঝাউতলার দিকে যেতে—রাস্তাটা সুনসান। সেদিন বলিউড নায়িকা তাপসী পান্নু টাইপ যুবতি—বান্ধবি নিয়ে তার দিকে আসছে। জমে থাকা বৃষ্টির জলে পা ভিজাতে না-চাইলে, খানাখন্দ রাস্তার একদিক ঘেঁষে যেতে হয়। মেয়েটার পারফিউমের ঘ্রাণ নাকে লাগা সত্ত্বেও সে নিজেকে শাসন করে, চাঁদের দিকে তাকায় না। হ্যাঁ, মদনবাণ ছোড়া হয়, সুন্দরীর উক্তি “মুখে রুচি নাই”। ১৯৭৯ সালে রচিত ‘প্রেমের গপ্পো’র বাস্তবতা বদলেছে। করোনার বছরে তালাকের ৭০ শতাংশ আবেদনই নারীর। পরিবর্তিত পরিবেশ এবং মনস্তত্ত্বে গল্পটার সুরতহালের পাশে পেছনের এক ঘুমহীন নিয়ন শহর। ইলিয়াস দেখে যেতে পারেননি—উড়াল সড়ক, মেট্টোরেল, হাতিরঝিল।
‘ত্রিপাদস্য দিবি’ প্রাচীন কথা। যার অর্থ প্রত্যেক মানুষের অস্তিত্বের ত্রিপাদ বা তিনভাগ (৭৫ শতাংশ) মনের এলাকা, আর একভাগ (২৫ শতাংশ দেহের এলাকা) রবীন্দ্রনাথের মতে আমাদের পূর্ব মহাদেশের লোকেরা মানুষের সেই মনের এলাকার সমস্যাগুলি সমাধান করার উপায় বের করার সাধনা করেছিলেন। পশ্চিম পুরো উল্টো তারা মনের সাধনা থেকে দেহের সাধনাই বেশি করেছে। এবং তা জোর করে অন্যের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। আমরা আসলে অন্যের সাপেক্ষে বাঁচি। এ ভাবনা হীনম্মন্যতা জন্ম দেয়। যা নিজের শক্তিকে শত্রুতে রূপান্তরিত করে। নিজের দিকে তাকানোর সময় নেই। খণ্ড খণ্ড ভাবনা দিয়ে পূর্ণকে বিবেচনায়, বসুধাকে ক্ষুদ্র করে রাখে। আসলে দুশো বছরের উপনিবেশ আমাদের যৌথ মননকে ধুলোয় ঢেকে রেখেছে। আরশিতে এখন দেখতে পাই ইউরোপ-আমেরিকা। এবং তার মতো না হলেই সব যেন বৃথা। লণ্ডন শহরের প্রতিটি ইটের গভীরে ক্ষরণের দাগ। স্তূপীকৃত জঞ্জালে যে বিষবৃক্ষের উদয়। তার নাম আবার এনলাইটমেন্ট। সেই আলো উজ্জ্বল করার বদলে রঞ্জন রশ্মির মাত্রাধিক্যে ক্যান্সার ছড়িয়েছে। শিল্প বিপ্লব না অস্ত্র বিপ্লব! মানুষের সমুদয় তৃপ্তিতে গ্রাস করেছে। কাফকার ‘মেটামরসিসে’ গ্রেগর সামসার বেলায় দেখি, নিয়মের শৃঙ্খলে বন্দি মানুষ আরশোলায় পরিণত হয়।
‘প্রেমের গপ্পো’র জাহাঙ্গীর ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করা সত্ত্বেও বলিউডের নায়কের মতো রোম্যান্টিক। বিয়ের বয়স কম বলেই হয়তো এমনটা। অথবা সেদিন ছুটির দিন ছিল। বউয়ের বুকে মাথা রেখে বিবাহ-পূর্ব সম্ভাব্য প্রেমিকাদের সঙ্গে লাইন মারার গল্প বলে যায়। বউটাও নাচুনি বুড়ি। তার বউ একটার পর একটা গপ্পো শুনে—গপ্পোর পালে হাওয়া লাগায়। সংসার স্বপ্নের দেশ বানিয়ে ছাড়ে। মাসলম্যান স্বামীর ভাগ্যে বোকাসোকা গান জানা ফর্সা রমণী। তারা যেন নিজেদের মধ্যে দুঃখবনসাই চাষ করে। বুলা স্বামীর বানানো প্রেমিকাদের কাহিনি বারবার শুনে বিনোদিত হয়। কিন্তু মাসলম্যান স্বামী বুলার গান শেখার সাথী, গানের মাস্টারমশাইয়ের কথা যখন শোনে একটু নড়েচরে বসে। উড়ন্ত বেলুনটা যেন মুহূর্তের মধ্যে জড়বৎ। জাহাঙ্গীরের চাকরির দু’ধরনের বর্ণনা পাই। যা পরস্পর বিপরীত। গল্পের শুরুর অংশে—ম্যানেজিং ডিরেক্টর তাকে বলে, ‘জাহাঙ্গীর অর্ডার তো ভালোই আনতাছ। গুড। দুইদিন পর পাখনা গজালে অন্য ফার্মে যাবার তাল উঠবে। এখানেই ভালো করে কাজ করো, ফার্মটারে তোলো। তোমরাও উঠতে পারবা। এখানে সিনসিয়ারলি কাজ করলে তোমার বাড়ি-গাড়ি সবই হবে।’ গল্পের শেষের দিকে, ‘অর্ডার আসে না কেন? কবীর অর্ডার আনে, বেলাল অর্ডার আনে, তুমি করো কী? ৃবৌয়ের সঙ্গে ম্যাদামার্কা ছেলেদের মতো দিনরাত কেবল ফুসুর ফুসুর করবে তো অর্ডার আনবে কোন বাবা?’ ভুবনবিখ্যাত কথাসাহিত্যিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের কথা মনে পড়ে। ‘সরল এরেন্দিরা ও তার নিষ্ঠুর ঠাকুরমার কাহিনী’ গল্পে দেখি, প্রেমেপড়া বুঝাতে মার্কেস রঙের পরিবর্তন দেখিয়েছেন। ইলিয়াস বিষাদ রাগীনির প্রকাশ চাকরির উত্থান-পতন ১৯৭৯ সালে কল্পদৃশ্যে এঁকেছেন। আমাদের মনে হয় না ইলিয়াস ১৯৮৪ সালের আগে মার্কেস পড়েছেন। পড়তেও পারেন কারণ ছাত্রাবস্থা থেকেই বিদেশি সাহিত্য সাময়িকীগুলোর একনিষ্ঠ পাঠক তিনি। জাহাঙ্গীর ইর্ষার বারুদে জ্বলে ওঠে। জাহাঙ্গীর গলে পুড়ে ছাই হয়। ইলিয়াস অনেকগুলো বিরোধকে একসাথে বেঁধেছেন। বুলা গান পছন্দ করে কিন্তু বিয়ে করে মাসলম্যান। জাহাঙ্গীর শরীরচর্চা করে কিন্তু আচরণ করে মন কারিগরের মতো। চাকরিতে তাঁর পারফরমেন্স যাচ্ছে তাই, কিন্তু কোনো মাথা ব্যথা নেই। অস্থির এক প্রাণ। ঠুনকো আঘাতে কাচের মতো ভেঙে যায়। তা না হলে সে কেন হিপওয়ালীকে কেন খুঁজবে? সেও একটা প্রেমিকা বগলে রেখে সমান হতে চায়। গুলশানের মেয়েটিকে কেন খুঁজবে? বড়লোকের মেয়েকে ঘরে তোলার সাধ্য নেই। মাসলের গরিমায় গল্পের ফুটানি তার যায় না। অন্যকে নিয়ে পরিহাস করতে ভালোই লাগে। কিন্তু নিজের কী অবস্থা! সে না হয় যুগপৎ কাঁদতে দেখেছে বুলাকে। কই বুলা তো তাকে একবারের জন্যও অবজ্ঞা করেনি। হয়তো বুঝে গেছে তার দৌড়! ভালোবাসা নামের অসুখ আর কি সহ্য করা যায়? তা নাহলে তো জীবন একটা টিক চিহ্ন। বর্ণনার কোনো বাড়াবাড়ি নেই। নাভীর নিচের মেদের মতো সুন্দর। হয়তো চখাচখির যৌথ জীবনে বুলার মাস্টার মশাই সেই মেদ।
উপনিবেশিক সময়ের পশ্চিমা আলোকায়নের রথে, পশ্চিমকে ছোঁবার একটা মায়াজাল সুকৌশলে বিস্তৃত করেছে। পঞ্চপাণ্ডবগণ আধুনিকতার চর্চা করেছিলেন। তা যেন অনেকটাই ইউরোপের ক্লাসে ভর্তি হবার জন্য। রবীন্দ্রনাথ প্রাচ্যের চিন্তাসূত্র দিয়েই পশ্চিমের চিন্তায় বার্তা দিয়েছেন। পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্যে শেকড়ের অন্বেষণ অনেকটাই মলিন। ১৯১৩ সালে বিশ্বচিন্তায় যেই সংযোগ তৈরি করেছেন তা আর ওই অর্থে তরঙ্গায়িত হয়নি। যদিও বিভূতিভূষণের চিত্ররূপ অস্কার জয় করেছে। আবার ফেরা যাক ‘প্রেমের গপ্পো’তে—যদি সুখ, দুঃখ, যন্ত্রণা ইউরোপের প্যারামিটারে তুলনা করা হয়। বুলা ঢাকার তুলনায় কুমিল্লাকে সুন্দর শহর বলেছে। সুনীল সেনগুপ্ত সেখানে থাকত বলেই কী! সুনীল বিয়ে করেনি। শিল্পের মগ্নতায় জৈবিক সুখকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। না বুলাকে না পাওয়ায়? বুলা তো সন্তানতুল্য বয়সী। এরকম কোনো নির্দেশনাই গল্পে নেই। জাহাঙ্গীরের আরোপিত চিহ্নটা গল্পের দ্বন্দ্ব। যে মানুষগুলো শুধু নিজের সুখ চায় শেষ পর্যন্ত সে যেন বিচ্ছিন্ন। মানুষ আসলে তৃপ্তি খুঁজে। যেখানে থাকে সুখ আর আনন্দ। দেহ কর্ম করলে সেখানে ধারন করে সুখ। মন সাধনা করলে সেখানে ফোটে আনন্দ। সুখে আর আনন্দেই তৃপ্তি মেলে। কিন্তু দেহ আর মনের সমন্বয়হীনতা দু’নৌকায় পা—জাহাঙ্গীর আর বুলার সমস্যাটা কোথায়? হয়তো ইলিয়াস নাগরিক মানুষের অস্থির সময়কে তুলে ধরতে সচেষ্ট ছিলেন। গুলশানে ৬ নাম্বার বাস এখনো আছে। যদিও মাথার উপরে কয়েকটা উড়াল সড়ক। আপাত কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘দ্য বাইসাইকেল থিফ’-এর শেষ দৃশ্যে বাবা ও ছেলের নীরব হেঁটে চলা অনেক কিছু বলে দেয়। জাহাঙ্গীরের তো ছেলে নেই। সে ভেসপায় আর একটু ঘুরে বেড়াক।