টার্মিনালের কোনও সুবিধা নেই। তবু ইজারা দেওয়া হয়েছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার তিনটি টার্মিনাল। ইজারা পেয়েই কোমর বেঁধে নেমেছে ইজারাদার। পুরো ডিএসসিসি এলাকাকেই যেন তারা টার্মিনাল ভেবে বসে আছে। সড়কে চলাচলরত পণ্যবাহী ও গণপরিবহন থেকে আদায় করতে শুরু করেছে টোল। যত্রতত্র নেওয়া হচ্ছে কুলি-মজুরির খাজনা। এমন ঘটনাকে চাঁদাবাজি বলছেন গণপরিবহন মালিক ও নগর বিশেষজ্ঞরা। ডিএসসিসি বলছে, তারা নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক গণপরিবহন থেকে টোল ও কুলি-মজুরি খাতে খাজনা আদায়ের জন্য তিনটি টার্মিনাল ইজারা দিয়েছে। টার্মিনালগুলো হচ্ছে- সায়েদাবাদ বাস টার্মিল, গুলিস্তান-জয়কালী মন্দির (সায়েদাবাদ সিটি) স্টপওভার বাস টার্মিনাল ও ফুলবাড়িয়া স্টপওভার বাস টার্মিনাল। এর মধ্যে সায়েদাবাদ টার্মিনালের টোল বিভাগীয় ব্যবস্থাপনায় আদায় করে আসছে ডিএসসিসি। গুলিস্তান-জয়কালী মন্দির স্টপওভার বাস টার্মিনালটি দুই কোটি ৯৩ লাখ টাকা ও ফুলবাড়িয়া স্টপওভার বাস টার্মিনাল ২ কোটি ৫০ লাখ টাকায় ইজারা দেওয়া হয়।
ডিএসসিসির পরিবহন বিভাগ সূত্র জানায়, গত বছরের ২৮ অক্টোবর গুলিস্তান-জয়কালী মন্দির স্টপওভার নিয়ে দরপত্র আহব্বান করে ডিএসসিসি। একই বছরের ১১ নভেম্বর এই টার্মিনালের ফি ও কুলিমজুরি খাতে রাজস্ব আদায়ে ইজারা পায় গুলশান চাকা লিমিটেড। ইজারা মূল্য দুই কোটি ৯৩ লাখ টাকার কিছু বেশি।
ইজারাদারদের টাকা আদায়ের রশিদইজারাদারদের টাকা আদায়ের রশিদ
কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি এখন গুলিস্তান ও জয়কালি মন্দির ছেড়ে মতিঝিল, কমলাপুর, জুরাইন, কদমতলী, পোস্তগোলা, শনির আখড়া, রায়েরবাগ, কোনাপাড়া, ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার, মাতুয়াইল, মেরাদিয়া, নন্দিপাড়া, মাদারটেক, যাত্রাবাড়ী এলাকার বাস, মিনিবাস, সিএনজিচালিত অটো, পিকআপ, ট্রাক, ব্যক্তিগত গাড়ি, মাইক্রোবাস থেকেও টোল আদায় করছে। এ ছাড়া এসব এলাকা থেকে টোল আদায়ে সাব-ইজারাদার নিয়োগ দিয়েছে গুলশান চাকা লিমিটেডের স্বত্বাধিকার জাকিয়া সুলতানা। বিনিময়ে নিয়েছেন মোটা অঙ্কের জামানত। এ ছাড়া এসব এলাকায় কোনও যাত্রী যৎসামান্য মালামাল বহন করতে চাইলেও জোর করে আদায় করা হচ্ছে কুলিমজুরি টোল।
ইজারার কার্যাদেশে বলা হয়েছে, গুলিস্তান-জয়কালি মন্দির (সায়েদাবাদ সিটি) স্টপওভার বাস টার্মিনাল সংশ্লিষ্ট এলাকা থেকে টোল আদায় করতে পারবে ইজারাদার। আরও বলা হয়েছে, সায়েদাবাদ সিটি বাস টার্মিনাল হতে ঢাকা সিলেট হাইওয়ে রুটে চলাচলকারী সকল বাস, মিনিবাস হতে ৬০ টাকা হারে টার্মিনাল ফি আদায় করা যাবে।
এ ছাড়া গুলিস্তান-জয়কালি মন্দির স্টপওভার বাস টার্মিনালের আওতাভুক্ত বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী প্রতিটি বাস, মিনিবাস হতে পার্কিং ফি সংস্থার অনুমোদিত রশিদ বইয়ের মাধ্যমে ৪০ টাকা করে আদায় করতে পারবে। সিএনজি, অটোরিক্সা, টেম্পু, লেগুনা হতে প্রতি ট্রিপ ১০ টাকা হারে এবং বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত পিকআপ হতে ৩০ টাকা হারে টোল আদায় করতে পারবে।
যানবাহন চালকদের অভিযোগ, টোলের নামে ডিএসসিসির মূল সড়কসহ সব অলিগলিতে চলছে চাঁদাবাজি। সাব-ইজারাদারদের অত্যাচারে চালকরা অতিষ্ঠ। প্রতিটি যানবাহন ও ট্রাক থেকে ৬০ টাকার পরিবর্তে আদায় করা হচ্ছে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। এসব জানার পরও ইজারাদারদের থামাতে পারছে না ডিএসসিসির পরিবহন বিভাগ।
শুধু পরিবহনেই ক্ষান্ত দেয়নি টোল আদায়কারীরা। দক্ষিণ সিটি এলাকার বিভিন্ন মার্কেট থেকে পাইকারি মালামাল ক্রয় করে রাস্তায় এলেই প্রতি কার্টনে ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হচ্ছে টার্মিনাল ও কুলি মজুরির খাজনা বাবদ। এ নিয়ে সম্প্রতি বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভও করেছেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু কোনও ব্যবস্থা নেয়নি সিটি করপোরেশন।
জানতে চাইলে গুলশান চাকা লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও জাকিয়া সুলতানার স্বামী আফতাব মাসুদ বলেন, ‘টার্মিনাল ও পার্কিং স্পেস নেই এটা ঠিক আছে। নির্দিষ্ট কিছু এরিয়া সিটি করপোরেশন ইজারা দিয়েছে। আমি তা নিয়েছি। ইজারার ও কার্যাদেশের বাইরে বাড়তি টাকা নিচ্ছি না। আমার ৩০-৪০ জন লোক আছে। তারা রশিদের মাধ্যমে নির্দিষ্ট পরিমাণ টোল আদায় করছে। তা ছাড়া আমরা ট্রাক থেকে কোনও টোল আদায় করি না। কাউকে সাব-ইজারাও দেওয়া হয়নি। স্থানীয় প্রভাবশালীদের অনেকে বিভিন্ন নামে টোল আদায় করছে। এই বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় পুলিশ বিভাগকে লিখিত অভিযোগও দিয়েছি।’
অপরদিকে গতবছরের ১৪ অক্টোবর হতে এক বছরের জন্য আড়াই কোটি টাকায় ডিএসসিসির মালিকানাধীন ফুলবাড়িয়া স্টপ ওভার টার্মিনালটি ইজারা নেয় মিনহাজ এন্টারপ্রাইজ। ইজারার শর্ত অনুযায়ী ইজারাদার টার্মিনালের আওতাভুক্ত গুলিস্তান-মিরপুর ১, ৯, ১০, ১১ ও ১২, চিড়িয়াখানা, এয়ারপোর্ট, আব্দুল্লাহপুর, ধামরাই, মানিকগঞ্জ, রামপুরা, গাবতলী, কালিয়াকৈর, কালীগঞ্জ, কলাকুপাবান্দুরা, সাভার, নবীনগর, আরিচা (বিআরটিএ কর্তৃক লিজ প্রদত্ত) কাপাসিয়া, গাজীপুর, টঙ্গী, শ্রীপুর, সখীপুর, শ্রীনগর, দোহার ও বাড়ৈখালী রুটে চলাচলকারী বাস-মিনিবাস প্রতি প্রতিদিন ৪০ টাকা হারে টার্মিনাল ফি ও নির্ধারিত কুলি-মজুরি আদায় করবে। অটোরিকশা-সিএনজি হতে প্রতি ট্রিপে ১০ টাকা ও টেম্পো হতে ৩০ টাকা হারে আদায় করা যাবে। কার্যাদেশে পরিবহনের নামও চিহ্নিত করে দেওয়া হয়েছে।
ইজারার শর্ত অনুযায়ী কোনও যাত্রী সামান্য মালামাল উঠানো বা নামানোর জন্য কুলিদের সাহায্য না চাইলে কোনও কুলি মালামাল স্পর্শ করা বা মজুরি দাবি করতে পারবে না।
কিন্তু স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অভিযোগ ইজারাদার টার্মিনাল বুঝে নেওয়ার পর থেকেই তারা দোকানপাটের সামনে থেকে টোল আদায় করছে। কোনও ব্যবসায়ী যদি তাদের গোডাউন থেকে মালামাল নিয়ে দোকানে নেয় সেখান থেকেও টোল নিচ্ছে। এ অভিযোগে গত ২০ অক্টোবর সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া সংস্থার মেয়রের কাছেও অভিযোগ করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এসব টার্মিনালের ইজারাদার সংশ্লিষ্ট অনেকেই জানিয়েছেন টার্মিনালগুলোর ইজারা নিতে বিপুল অংকের অর্থ ঘুষ দিয়েছেন। ওই টাকা তুলতেই চলছে এ চাঁদাবাজি।
দক্ষিণ সিটিতে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালটি মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের কারণে অনেকটা ছোট হয়ে পড়েছে। তবে কিছু সংখ্যক পরিবহন রাখার ব্যবস্থা থাকায় সেখান থেকে ডিএসসিসি বিভাগীয় ব্যবস্থাপনায় টোল আদায় করা হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী টার্মিনাল থেকে বের হওয়ার সময় এই টোল আদায় করার বিধান থাকলেও করপোরেশনের নিয়োগকৃত লোকেরা আশপাশের পুরো এলাকা থেকে টোল আদায় করছে।
হিমাচল পরিবহনের হেলপার গিয়াস উদ্দিন বলেন, টঙ্গী থেকে বাস নিয়ে সায়েদাবাদ হয়ে নোয়াখালী যাতায়াত করি। টার্মিনাল ব্যবহার করি না। কিন্তু এরপরও সায়েদাবাদের রাস্তায় এলে টোল দিতে হয়।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. সরওয়ার জাহান বলেন, নীতিমালার বাইরে সড়ক ইজারা দিয়ে টোল আদায় করাটা নিছক চাঁদাবাজি। টার্মিনাল ও পার্কিংসহ সকল সুবিধা নিশ্চিত করে তারপরই ইজারা দেওয়া উচিত ছিল। সেসব না করে ইজারা দেওয়ায় সড়কে চাঁদাবাজি বাড়বে।
জানতে চাইলে ডিএসসিসির মহা-ব্যবস্থাপক (পরিবহন) বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘গুলিস্তান-জয়কালী মন্দির (সায়েদাবাদ সিটি) স্টপওভার বাস টার্মিনালে ইজারা আদায় নিয়ে অনিয়মের কথা শুনেছি। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের লোকজনকে ডেকে সতর্ক করেছি। কেউ লিখিত অভিযোগ করেনি। অভিযোগ ও প্রমাণ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ওই টার্মিনাল এলাকায় ট্রাক, ব্যক্তিগত গাড়ি, মাইক্রো, পিকআপ, অটোরিকশা থেকে টোল আদায় করা যাবে না। টার্মিনালের বাইরের কোনও রাস্তা থেকেও টোল আদায় করা যাবে না।’
এ ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, ‘ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন গুলিস্তান-জয়কালি মন্দির (সায়েদাবাদ সিটি) এলাকায় কোনও বাস টার্মিনাল কিংবা পার্কিং স্পেস ইজারা দেওয়া হয়নি। ইজারা হয়েছে নির্দিষ্ট কিছু এলাকার স্টপওভার বাস টার্মিনাল এবং নির্দিষ্ট কিছু পরিবহন। বাড়তি টোল আদায়ের কোনও অভিযোগ আমি পাইনি। তবে ইজারাদার ছাড়া অন্য লোকজন সংশ্লিষ্ট এলাকা থেকে চাঁদা আদায় করছে এমন অভিযোগ পেয়েছি। ৩১ জানুয়ারি পুলিশকেও বিষয়টি জানানো হয়েছে।’