ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২১ই নভেম্বর ২০২৪ , বাংলা - 

ক্ষুদ্র ঋণের নামে চার কোটি টাকা আত্মসাৎ!

2021-02-12, 12.00 AM
ক্ষুদ্র ঋণের নামে চার কোটি টাকা আত্মসাৎ!

নতুন করে চৌদ্দটি শাখা খুলে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ করা হবে- এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে ব্যাংক থেকে চার কোটি টাকা নিয়েছিল সচেতন সাহায্য সংস্থা’ নামে একটি এনজিও। কিন্তু নতুন কোনও শাখাও খোলা হয়নি, বিতরণ করা হয়নি ঋণও। স্বাক্ষর জালিয়াতি ও ভুয়া রেজোল্যুশন তৈরি করে ঋণের নামে নেওয়া সব টাকা আত্মসাৎ করেছেন এনজিও’র সভাপতি, সেক্রেটারি ও নির্বাহী পরিচালক। এই টাকা আত্মসাতে তাদের সহযোগিতা করেছেন ব্যাংকের এমডিসহ কয়েকজন কমকর্তা। দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে তাদের অর্থ আত্মসাতের পুরো কাহিনী।

ব্যাংক কর্মকর্তাসহ এনজিওটির উর্ধ্বতন তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। দুদকের সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। জালিয়াতি করে অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান চলছে।’

দুদক সূত্রে জানা গেছে, ২০০৫ সালে এনজিও ব্যুরো থেকে নিবন্ধন নিয়ে কার্যক্রম শুরু করে সচেতন সাহায্য সংস্থা প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয় শান্তিনগরে। আট সদস্য বিশিষ্ট নির্বাহী কমিটির সদস্যদের মধ্যে নির্বাহী পরিচালক হিসেবে জেসমিন রশিদ, সভাপতি হিসেবে হাসনা হেনা ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নাছরিন আক্তার দায়িত্ব পালন করছিলেন। এই তিন জন বাকিদের স্বাক্ষর জালিয়াতি করে ভুয়া রেজোল্যুশন তৈরি করে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের প্রগতি সরণী শাখায় প্রথমে একটি চলতি হিসাব খোলেন। পরবর্তীতে এই তিন জন জালিয়াতি করে ওই শাখায় ৩০ কোটি টাকা ঋণের আবেদন করেন। কিন্তু প্রথম ঋণের আবেদন নাকচ হয়ে গেলে দ্বিতীয় দফায় আবারও তারা আবেদন করেন। শাখা ব্যবস্থাপক তা পুনরায় রিভিউয়ের জন্য প্রধান কার্যালয়ে পাঠালে প্রধান কার্যালয় থেকে চার কোটি টাকা সিকিউরড ওভারড্রাফট লোন বা এসওডি হিসেবে মঞ্জুর হয়।

পরবর্তীতে এনজিওটির নির্বাহী কমিটির তিন সদস্য অন্য সদস্যদের ভিপি নোট, লেটার অব গ্যারান্টিসহ অন্যান্য চার্জ ডকুমেন্টসে স্বাক্ষর করে ব্যাংক কর্মকর্তাদের সহযোগীতায় মাত্র চার দিনের মাথায় পুরো টাকা তুলে নেন। ঋণ প্রাপ্তির শর্ত হিসেবে ১০ শতাংশ এফডিআর করে রাখার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। এমনকি ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণের নামে নেওয়া ঋণ এনজিওর কাজে ব্যবহার না করে এই তিন জন আত্মসাত করেন বলে দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।

দুদক সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে সচেতন সাহায্য সংস্থা স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের প্রগতি সরণী শাখায় ৩০ কোটি টাকা এসওডি ঋণের আবেদন করে। শাখা অফিস ওই আবেদন ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল ক্রেডিট ডিভিশনে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু ব্যাংকের ১০ সদস্যের ম্যানেজমেন্ট ক্রেডিট কমিটি তাদের প্রস্তাবটি নাকচ করে দেয়। নাকচ করে দেওয়ার কারণ হিসেবে সচেতন সাহায্য সংস্থার সম্পর্কে বলা হয়, তাদের সিআইবি প্রতিবেদনে কিছু ঋণের কিস্তি বকেয়া রয়েছে। মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির গোপনীয় প্রতিবেদনেও সচেতন সাহায্য সংস্থার অডিট আপত্তি অমিমাংসীত রয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়। এছাড়া তাদের সক্ষমতা নিয়ে আপত্তি করা হয় ওই কমিটির মূল্যায়ন প্রতিবেদনে। সেখানে ব্যাংকটির  তৎকালীন এমডি ও সিইও মামুন উর রশীদ, ম্যানেজমেন্ট ক্রেডিট কমিটির চেয়ারম্যান ও অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারিকুল আজম ও এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল ক্রেডিট ডিভিশনের প্রধান আমিনুল ইসলাম স্বাক্ষর করেন।

কিন্তু এরপর এই তিন কর্মকর্তাই আবার এক পাতার রিভিউ লিখে চার কোটি টাকা ঋণ প্রদানের সুপারিশ করে তা প্রধান কার্যালয়ে পাঠান। পরে সেই ঋণ প্রস্তাব সরাসরি ২০১৮ সালের ৯ মে অনুষ্ঠিত ২৯৩তম বোর্ড সভায় উত্থাপিত করা হলে তাতে অনুমোদন দেওয়া হয়।

দুদক সূত্র জানায়, সচেতন সাহায্য সংস্থার নামে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের মালিবাগ শাখায় একটি হিসাব খোলা ছিল। আগে ওই শাখার ব্যবস্থাপক ছিলেন শোয়াইব মাহমুদ তুহিন। তিনি প্রগতি সরণী শাখায় বদলি হলে এনজিওটির ব্যাংক হিসাবও তার শাখায় নিয়ে যান। শোয়াইব মাহমুদ তুহিনের যোগ-সাজশেই প্রথম দফায় ঋণ আবেদন নাকচ হয়ে আসার পর দ্বিতীয় দফায় আবারও ঋণ আবেদন করানোর ব্যবস্থা করা হয়। দ্বিতীয় দফায় আবেদনের সময় ব্যবস্থাপন শোয়াইব মাহমুদ তুহিন, অপারেশন ম্যানেজার শেখ মনসুরুল করিম ও শাখায় নতুন যোগদানকৃত সিনিয়র অফিসার সুরাইয়া আহমেদ স্বাক্ষরতি দ্বিতীয় ঋণের আবেদনটি প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়।

জালিয়াতির অনুসন্ধানকারী দুদকের একজন কর্মকর্তা বলেন, শাখা ব্যবস্থাপক ও অপারেশন ম্যানেজার সচেতন সাহায্য সংস্থা যে ঋণ পাওয়ার যোগ্য নয়, এই বিষয়টি জানতেন। কিন্তু তাদের যোগ-সাজশেই ঋণের প্রস্তাবটি প্রধান কার্যালয়ে পাঠিয়ে তা কৌশলে অনুমোদন করিয়ে নেওয়া হয়।

দুদক সূত্র জানায়, পরিচালনা পর্ষদের ঋণ অনুমোদনের সিদ্ধান্ত দ্রুত প্রগতি সরণী শাখায় পাঠানো হলেও শাখা অফিসও অতি দ্রুততার সঙ্গে সচেতন সাহায্য সংস্থাকে চার কোটি টাকা ঋণ দিয়ে দেয়। ঋণ দেওয়ার যে শর্তগুলো তাও প্রতিপালন করা হয়নি। ঋণ হিসাব থেকে দ্রুততার সঙ্গে ঋণের টাকা সচেতন সাহায্য সংস্থার তিন কর্মকর্তার জালিয়াতি করে করা চলতি হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। সেখান থেকে সচেতন সাহায্য সংস্থার তিন কর্মকর্তা তুলে তা আত্মসাৎ করেন।

দুদক কর্মকর্তা মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীন জানান, জালিয়াতি ও বিশ্বাসভঙ্গের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে সচেতন সাহায্য সংস্থার নির্বাহী পরিচালক জেসমিন রশিদ, সভাপতি হাসনা হেনা ও সাধারণ সম্পাদক নাছরিন আক্তারসহ স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের সাবেক এমডি ও সিইও মামুন উর রশিদ, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারিকুল আজম ও এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল ক্রেডিট বিভাগের প্রধান আমিনুল ইসলাম, প্রগতি স্মরণী শাখার ব্যবস্থাপক শোয়াইব মাহমুদ তুহিন ও অপারেশন ম্যানেজার শেখ মোহাম্মদ মুনসুরুল করিমের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।

এদিকে অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে একাধিকবার সচেতন সাহায্য সংস্থার নির্বাহী পরিচালক জেসমিন রশিদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তাদের এনজিও’র কার্যালয়টিও বর্তমানে বন্ধ রয়েছে।