তখন সকাল সাতটা। মেয়ে সুমনাসহ সখিনা বিবি এবং আরও বেশ কয়েকজন বসা ছিলেন রাজধানীর পূর্ব রামপুরার শাহাদৎ রোডের ওপেন মার্কেট সেল বা ওএসএস ডিলারের দোকানের সামনে। প্রতিদিন সেখানে সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ওএমএসের চাল ও আটা বিক্রি হয়। সকাল ১০টা থেকে শুরু হয় বিক্রি। তবে বহু মানুষের জটলার মধ্যে পণ্য পাওয়ার নিশ্চয়তা পেতে ভোক্তাদের অনেকে ভোর থেকে সেখানে লাইন দেন।
বৃহস্পতিবার (১৫ ডিসেম্বর) সকালে রামপুরা রোডের সেই ওএমএস ডিলারের দোকানের সামনে গিয়ে কথা হয় সখিনা বিবির সঙ্গে। তিনি বলেন, আগে না এলে চাল-আটা পাই না। অনেক সময় খালি হাতে ফিরতে হয়। সেজন্য ফজরের নামাজ পড়ে চলে এসেছি।
তিনি জানান, মেয়ে সুমনাকে লাইনে বসিয়ে তিনি যাবেন অন্যের বাসায় কাজ করতে। বাসাবাড়ির কাজ শেষে ফিরে আবার দাঁড়াবেন লাইনে। এরপর সুযোগ পেলে সুমনা যাবেন স্কুলে।
সখিনা বলেন, স্বামী রিকশা চালায়। বাজারে সবকিছুর যে দাম তাতে ওএমএসের পণ্য বড় ভরসা। যে কোনোভাবেই হোক প্রতি সপ্তাহে এখান থেকে চাল-আটা সংগ্রহ করি।
কথা হয় সেখানে ওএমএসের পণ্যের জন্য লাইনে অপেক্ষমান আরও তিন নারীর সঙ্গে। তাদের মধ্যে দুজন বৃদ্ধা এসেছেন সন্তানের পরিবারের জন্য পণ্য কিনতে। তারা জানান, নিয়মিত তারা ওএমএসের পণ্য কেনেন। তাতে সংসারের খরচ কিছুটা সাশ্রয় হয়। চাল-আটা সংগ্রহ করে সন্তানের পরিবারের খরচ বাঁচাতে তারা বড় ভূমিকা রাখেন।এসময় লাইনে অপেক্ষমান আরেক মধ্যবয়সী নারীর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি বিরক্ত বোধ করেন। কথা বলতে রাজি হন না। তিনি শুধু এটুকু বলেন- কথা বলে কী লাভ! আপনারা কি আমাদের চাল-আটা পাইয়ে দেবেন? এ চাল না পেলে পোলার বাপ এসে বকাবকি করে। চালের বাড়তি দাম আপনি দেবেন?
মানুষের কষ্ট লাঘবের জন্য সরকারের খাদ্য অধিদপ্তরের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ওএমএসের বিক্রয়কেন্দ্রে মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মাঝে সুলভ মূল্যে চাল ও আটা বিক্রি করা হচ্ছে। তবে তা চাহিদার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল, বলছেন ভোক্তারা। এছাড়া ওএমএসের চাল-আটা পেতে ক্রেতাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। দীর্ঘ অপেক্ষার পরও অনেককে চাল-আটা না পেয়ে খালি হাতেই ফিরতে হচ্ছে।
ওএমএস পণ্যের এই ক্রেতারা জানান, তারা প্রতি কেজি চাল ৩০ টাকা দরে সবোর্চ্চ ৫ কেজি কিনতে পারেন। তাতে তাদের ব্যয় হয় ১৫০ টাকা, অথচ বাজারে একই পরিমাণ চালের দাম ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ টাকা। তারচেয়েও বেশি সাশ্রয় হচ্ছে আটায়। কারণ, প্রতি কেজি ওএমএসের আটার দাম ২৪ টাকা, যা বাজারে ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। ফলে ওএমএসের ৫ কেজি আটায় তাদের সাশ্রয় হয় ২০০ টাকারও বেশি।ক্রেতাদের সঙ্গে এসব কথোপকথনের পর সকাল ১০টায় সেখানে ওএমএসের দোকান খুলতেই চোখে পড়ে শতাধিক মানুষের ভিড়। তখন লাইনে অপেক্ষমান ক্রেতাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে একটি সিরিয়াল তৈরি করেন ডিলার হুমায়ূন তালুকদার।
তিনি জাগো নিউজকে জানান, এক টন চাল ও এক টন আটা বরাদ্দ পেয়েছেন তিনি। অর্থাৎ ৫ কেজি করে হিসাবে ২০০ জন ক্রেতার কাছে বিক্রি করতে পারবেন। ক্রেতা বেশি হলে অন্যদের খালি হাতে ফিরতে হবে। প্রতিদিনের নির্ধারিত ক্রেতাসংখ্যার মধ্যে থাকতে গত কিছুদিন ধরেই ভোর থেকে মানুষকে লাইন দিতে দেখা যায়।
হুমায়ূন তালুকদার বলেন, যখন চাল-আটার দাম কম ছিল তখন ওএমএসের পণ্য নিয়ে সারাদিন বসে থাকতাম। দিনে পাঁচ বস্তা আটাও বিক্রি হয়নি। এখন এক গাড়ি দিলেও শেষ হয়ে যায়।
তার সঙ্গে কথা বলার সময়ই অন্যদিকে ওএমএসের চাল-আটা বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। বিক্রি শুরুর পরই হঠাৎ সেখানে হইচই পড়ে যায়। কে কার আগে পণ্য নেবে, এ প্রতিযোগিতা শুরু হয়। তখন মর্জিনা বেগম নামের এক নারীকে বলতে শোনা যায়, সিরিয়ালি নিলে সুন্দরভাবে নিতে পারে। কিন্তু কেউ সেটা মানতে চায় না। তখন পেছন থেকে কয়েকজন মর্জিনার এ যুক্তিতে সমর্থন দিয়ে চিৎকার করে ওঠেন। আবার কেউ তার কথার বিরোধিতাও করেন। এরই মধ্যে সেখানে শুরু হয় যে যার মতো হুড়োহুড়ি, ঠেলাঠেলি।এদিন সকালে রাজধানীর সিপাহীবাগে ওএমএস ডিলারের দোকানে গিয়েও দেখা যায় একই চিত্র। সেখানেও দুই শতাধিক নারী-পুরুষ তিনটি লাইনে দাঁড়িয়ে গেছেন। এরমধ্যে দুটি সারি নারীদের। লাইনে দাঁড়ানো নিয়ে অনেকের মধ্যে কথা কাটাকাটিও চলছিল। সেখানকার ক্রেতাদের অভিযোগ, প্রতিদিনই ডিলার আসতে দেরি করেন। এতে লাইন দীর্ঘ হয়ে যায়। এরপর বিক্রি শুরু হলে হট্টগোল তৈরি হয়।
সেখানকার ডিলারের সহযোগী শফিক বলেন, ভাই, পণ্য দেবো নাকি গন্ডগোল ঠেকাবো। এখানে দাঁড়ান, পাঁচ মিনিট পরপর শুরু হবে গন্ডগোল। কার এত ধর্য হয় বলুন?
তিনি বলেন, নিজের সিল, স্বাক্ষর ও সিরিয়াল নম্বর দিয়ে এনআইডি ফটোকপি দিয়ে লাইন দিয়েছি। তারপরও কেউ মানতে চায় না। কে কার আগে পণ্য নেবে সেজন্য সবাই হুড়োহুড়ি করে।সেখানকার ডিলার মজনু শেখ বলেন, চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কম থাকায় এতো সমস্যা। একজন ডিলারকে একদিনের জন্য এক টন চাল ও এক টন আটা বরাদ্দ দেওয়া হয়। তা-ও প্রতিদিন নয়। কোনো সপ্তাহে দুদিন, কোনো সপ্তাহে তিনদিনের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। ডিলাররা একদিনে ২০০ জনের কাছে পণ্য বিক্রি করতে পারে। কিন্তু পণ্যের জোগানের তুলনায় চাহিদা দু-তিনগুণ বেশি।
বর্তমান ঊর্ধ্বমূল্যের বাজারে ওএমএসের চাল-আটার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা মানুষের অপেক্ষা নতুন নয়। এসব ডিলারের দোকানের সামনে বিশৃঙ্খলাও এখন নিত্যদিনের চিত্র। বিশেষত বাজারে নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে এসব পণ্যের চাহিদা তুঙ্গে। কিন্তু বরাদ্দ কম থাকায় নিম্নআয়ের মানুষের জন্য সরকারের ভর্তুকি দামে চাল-আটা বিক্রির উদ্যোগে খুব বেশি সুফল মিলছে না। এক্ষেত্রে পণ্যের বরাদ্দ বাড়ানোর বিকল্প নেই।
সাধারণ মানুষ ও ডিলাররা বলছেন, ঢাকার ৭০টি স্থানে বিক্রি করা হয় ওএমএসের পণ্য। তবে নিম্নবিত্ত ও বস্তি এলাকায় ওএমএসের ট্রাকে পণ্য বিক্রির পরিমাণ চাহিদার তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল। এখন ওএমএসের ট্রাকের সামনে মানুষের সারি দীর্ঘ হচ্ছে। বরাদ্দ কম থাকায় পণ্য কিনতে না পেরে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ খালি হাতে ঘরে ফিরছেন।