সংবিধান লঙ্ঘন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনিদের দেশত্যাগে সহায়তা এবং তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের অভিযোগে অভিযুক্ত সাবেক রাষ্ট্রপতি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। যারা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের মদত দিয়েছে তারাও অপরাধী। এই অপরাধীরা কোনও সম্মানজনক পদ, পুরস্কার বা খেতাব পেতে পারে না। সে জন্যই জিয়াউর রহমানের খেতাব বাতিলের সুপারিশ করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। কিন্তু কবে নাগাদ, কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় জামুকার এই সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হবে সে প্রশ্ন এখন সবার।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, খেতাব বাতিলে সরকারকে এখন গেজেট প্রকাশ করতে হবে। গেজেট প্রকাশের পরই কার্যকর হবে জামুকার সুপারিশ। সঙ্গে জিয়াউর রহমানের পাওয়া সব ধরনের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধাও বাতিল হবে। কিন্তু কবে নাগাদ এ প্রক্রিয়া শেষ হবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট প্রক্রিয়ার ধারণা দিতে পারছেন না দায়িত্বশীল কেউ। এমনকি কোন মন্ত্রণালয় এই গেজেট প্রকাশ করবে সে বিষয়টিও স্পষ্ট করা হয়নি। দায়িত্বশীলদের কাছে জানতে চাইলে অনেকেই প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন কৌশলে। তারা বলছেন, স্পর্শকাতর বিষয়, আপাতত তাই কোনও মন্তব্য নয়। আবার কেউ বলছেন, যারা খেতাব দিয়েছেন, বাতিল করার ক্ষমতাও একমাত্র তাদের। কারা খেতাব দিয়েছেন জানতে চাইলেও জানাননি এর সঠিক উত্তর।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন যুগ্ম সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে উল্টো জানতে চেয়েছেন, স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে খেতাব কি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ দিয়েছে যে খেতাব বাতিল সংক্রান্ত গেজেট মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ দেবে? কোন মন্ত্রণালয় থেকে এই খেতাব দেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে ওই যুগ্ম সচিব জানান, তখন তো আর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠিত হয়নি। হয়তো বিষয়টি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার ছিল। এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে উত্তর না দিয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা এড়িয়ে গেছেন নানা অজুহাতে।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বের ক্রমানুসারে খেতাব হচ্ছে- বীরশ্রেষ্ঠ, বীর উত্তম, বীর বিক্রম ও বীর প্রতীক। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পরই এই পদকগুলো দেওয়া হয়। ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ গেজেটের একটি অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে পদকপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করা হয়।”
জানা গেছে, জামুকার ৭২তম সভায় মঙ্গলবার (৯ ফেব্রুয়ারি) মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে স্বাধীনতার পর জিয়াউর রহমানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে দেওয়া ‘বীর উত্তম’ খেতাব বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে। স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর পর তার রাষ্ট্রীয় খেতাব বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিলো জামুকা। একইসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি শরিফুল হক ডালিম, নূর চৌধুরী, রাশেদ চৌধুরী ও রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনের রাষ্ট্রীয় খেতাবও বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।
এখন পর্যন্ত জামুকার বৈঠকের কার্যবিবরণী পায়নি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। জামুকা থেকে বৈঠকের কার্যবিবরণী পাওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়েরই বাকি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার কথা। অর্থাৎ গেজেট প্রকাশ করবে তারা। অতীতেও বীর মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়া সংক্রান্ত সব ধরনের গেজেট প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
সূত্র জানায়, কিন্তু এবারের বিষয়টি স্পর্শকাতর বলে সরাসরি গেজেট প্রকাশের দায়িত্ব মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় নাও নিতে পারে। এক্ষেত্রে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত এবং মন্ত্রিপরিষদে বিষয়টি উপস্থাপন করে অনুমোদন চাইতে পারে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এর জন্য জামুকা থেকে কার্যবিবরণী পাওয়া পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করবে। এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের সচিব কেউই কথা বলেননি।
জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব রথীন্দ্রনাথ দত্ত জানিয়েছেন, যেহেতু বিষয়টি এখন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের, সেহেতু গেজেট মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ই প্রকাশ করবে। তবে এর আগে জামুকার বৈঠকের কার্যবিবরণী মন্ত্রণালয়ে আসতে হবে। জামুকার কার্যবিবরণী দেখেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে জামুকার পরিচালক (যুগ্ম সচিব) সেলিম ফকির জানিয়েছেন, জামুকার সিদ্ধান্ত নেওয়া বৈঠকের কার্যবিবরণী খুব দ্রুতই মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। মন্ত্রণালয় এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে। এটি মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার। গেজেট প্রকাশ করার প্রয়োজন হলে তাও প্রকাশ করবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধে পাওয়া ‘বীর উত্তম’ খেতাব বাতিলে আইনি কোনও জটিলতা বোধহয় নাই। তিনি বলেন, যিনি মুক্তিযোদ্ধা নাম ধারণ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নষ্ট করেছেন, তার কি খেতাব থাকার কোনও অধিকার আছে? এই প্রশ্ন আমি দেশবাসীর কাছে রাখলাম।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘বিষয়টি আমি এখনও জানি না।’
উল্লেখ্য, সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যার ষড়যন্ত্রে জিয়াউর রহমানের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে বরাবরই অভিযোগ করা হয়। তবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলায় তাকে আসামি করা হয়নি।