জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয়কর, মূসক ও শুল্ক ফাঁকি রোধে সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি) কাজ করছে। এ সেল মূলত গোপন তথ্যের ভিত্তিতে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এদের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা আনা প্রয়োজন বলে মনে করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ৭ ফেব্রুয়ারি (২০২১) রাষ্ট্রপতির কাছে দেওয়া বার্ষিক প্রতিবেদনে এই সুপারিশ করে সংস্থাটি। প্রতিবেদনটি মূলত দুদকের ২০১৯ সালের কার্যক্রমের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা।
রাষ্ট্রপতির কাছে দেওয়া প্রতিবেদনে দুদক উল্লেখ করেছে, একটি নির্দিষ্ট মাত্রার কর ফাঁকির ক্ষেত্রে এই সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল উদ্যোগী হয়ে কাজ করবে তা নির্ধারণ করা জরুরি। ছোট ছোট কর ফাঁকির বিষয়গুলো জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ফিল্ড অফিসগুলো প্রতিরোধ করতে সক্ষম। সেসব কর ফাঁকির বিষয়ে এই ইন্টেলিজেন্স সেলের সম্পৃক্ত না হওয়াই শ্রেয়। এছাড়া কর ফাঁকির তথ্য পাওয়ার পর এটা থেকে প্রাপ্য রাজস্ব আদায় ও মামলা নিষ্পত্তিতে অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা লক্ষ করা যায়। কর ফাঁকির বিষয়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম দ্রুত শেষ করার জন্য নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা প্রয়োজন। অর্থাৎ কোনও একটা কর ফাঁকির বিষয়ে অনুসন্ধান শুরুর পর ছয় মাস কিংবা এক বছরের মধ্যে রিপোর্ট প্রদান করার সময়সীমা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। এতে এই সংস্থার কাজে দায়বদ্ধতা ও গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে। কর ফাঁকিবাজদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করতেও সক্ষম হবে।
দুদকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের প্রণোদনা হিসাবে বিপুল পরিমাণ আর্থিক সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এরূপ গোয়েন্দা কার্যক্রমের জন্য প্রণোদনা দেওয়া যুক্তিসঙ্গত হলেও তা একটি আইনের আওতায় যুক্তিসঙ্গত পরিমাণের হওয়া উচিত। বর্তমানে প্রণোদনা প্রদান ব্যবস্থাটি পরীক্ষাপূর্বক প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের পরিবর্তে নির্দিষ্ট যৌক্তিক হারে প্রণোদনা প্রদানের জন্য আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন। একইভাবে আয়কর, শুল্ক ও মূসক আদায়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে প্রণোদনা প্রদানের যে বিধান রয়েছে তা পুনঃনিরীক্ষা করা প্রয়োজন। সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল, বৃহৎ করদাতা ইউনিট বা এলটিইউ, শুল্ক ও মূসক আদায়ে তথাকথিত অসাধারণ ভূমিকা রাখার ভিত্তিতে মাত্রাতিরিক্ত প্রণোদনা বা পুরস্কার দেওয়া হলে এসব সংস্থায় কর্মরত কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি আত্মশ্লাঘা বা অহংবোধ জন্ম নেয়। যা অন্য কর্মকর্তাদের অস্বস্তির কারণ হতে পারে।
প্রতিবছর এবং সমগ্র কর্মজীবনে একজন কর্মকর্তার জন্য এরূপ আর্থিক প্রণোদনার একটা সুনির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
দুদক প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পৃথিবীর খুব কম দেশ আছে, যেখানে শুল্ক বিভাগ ভ্যাট আদায় করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে ভ্যাট ও আয়কর একে অপরের পরিপূরক। ভ্যাটের মাধ্যমে ব্যবসার পরিধি অর্থাৎ বিক্রয় ও আয় জানা যায়। যা প্রকৃত আয়কর নির্ধারণের জন্য একান্ত প্রয়োজন। এ কারণে আয়কর ও ভ্যাটকে একই প্রশাসনিক কাঠামোর আওতায় আনা প্রয়োজন। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই প্রত্যক্ষ কর প্রশাসনই ভ্যাট ও আয়কর আদায় করে থাকে। শুল্ক বিভাগের কাজের প্রকৃতির সঙ্গে ভ্যাটের আদৌ কোনও সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও আমাদের দেশে শুল্ক বিভাগ ভ্যাট আদায়ে নিযুক্ত। এতে প্রকৃত আয়কর ও ভ্যাট আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না।
দুদক প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কর ফাঁকি, বিদেশে অর্থপাচার, সন্ত্রাসী কার্যক্রমে অর্থায়ন ও মাদকপাচার রোধে রাষ্ট্রের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, যেমন- দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে কর ফাঁকি, অর্থপাচার, সন্ত্রাসী অর্থায়ন ও মাদকপাচার সম্পৃক্ত তথ্য পরস্পরের মাঝে আদান প্রদানের মাধ্যমে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব। এজন্য একটি নির্দিষ্ট কর্মপরিধির আওতায় আন্তসংস্থা কাঠামো (সমন্বয় কমিটি) গঠন করা প্রয়োজন। নির্দিষ্ট সময় পর পর বা প্রয়োজনে এসব সংস্থার প্রতিনিধিরা একত্রিত হয়ে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে উল্লেখিত অপরাধ দমনে ভূমিকা রাখতে পারেন।