খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও মীর জাফর আলী খান ইতিহাসের দুই খলনায়ক। উভয়ই ক্ষমতায় মসনদে বসেছিলেন চক্রান্ত হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে। আবার তাদের ক্ষমতাচ্যুতিও হয় সমর্থনকারীদেরই চক্রান্তে। তাদের পরস্পরের মধ্যে মিল এবং যোগসূত্রও ছিল এক ও অভিন্ন। পার্থক্য কেবল ১৭৫৭ সালের ৩ জুলাই মীর জাফর যখন বাংলার ক্ষমতার মসনদে বসছিলো, তখন নবাব সিরাজউদ্দৌলার মস্তকবিহীন মরদেহটা মাদী হাতির পিঠে বেঁধে রাজধানী মুর্শিদাবাদ ঘুরছিল। আর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মোশতাক যখন মসনদে বসছিলো, তখন স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর মরদেহটা তারই বাড়ির সিঁড়ির কোনে পড়ে ছিলো।
দু'টি হত্যাই প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও বৈদেশিক চক্রান্তের ফল। কিন্তু দু'জনের হত্যাকারীই বাঙালি। বঙ্গবন্ধুর হত্যার ষড়যন্ত্রকারী মোশতাক গং। হত্যাকারী মেজর নূর। সিরাজুদ্দৌলার হত্যার ষড়যন্ত্রের হোতা মীর জাফর গং। হত্যাকারী মোহাম্মদী বেগ।
ইংরেজরা যখন ট্যাংকবহর সহকারে সিরাজের মস্তকহীন লাশ নিয়ে অলিগলি প্রদক্ষিণ করছিল, তখন মুর্শিদাবাদবাসী প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে অবাক বিস্ময়ে তা অবলোকন করছিলো। অপরদিকে, নিহত বঙ্গবন্ধুর লাশ তার বাসভবনে পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে রেখে খুনীরা যখন ট্যাংকবহর নিয়ে বেতার স্টেশন থেকে বঙ্গভবন অভিমুখে, তখনো ভীতসন্ত্রস্ত নির্বাক রাজধানীবাসী তা অবলোকন করছিল।
'৭৫ সালের ৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় মন্ত্রিসভার বৈঠক বঙ্গভবনে। পদাতিক বাহিনীর কর্নেল শাফায়াত জামিল সশস্ত্র সৈন্য নিয়ে কেবিনেট কক্ষে। মন্ত্রীদের বরাবর অস্ত্র তাক। ট্রিগারে হাত। মোশতাকের সব মন্ত্রীই বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রী। মেজর ইকবাল চিৎকার করে বলছিলো, ‘গৎ. চৎবংরফবহঃ, ুড়ঁ ধৎব ধ নধংঃধৎফ, ুড়ঁ ধৎব ধ শরষষবৎ. ণড়ঁ ধষষ রিষষ হড়ি নব ভরহরংযবফ. ডব ধিহঃ কযধষবফ গড়ংযধৎৎধভ, ঐব যধং ঃড় নব সধফব ঈযরবভ ড়ভ ঝঃধভভ.’ খালেদ মোশাররফ রাষ্ট্রপতি পদে খন্দকার মোশতাকের পতন চাননি। তার কেবল সেনাপ্রধানের পদটি চাই।
সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফও তৎকালীন সেনা উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বক্তব্যকেই সমর্থন করেন। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের পছন্দেই ২৪ আগস্ট জিয়া সেনাপ্রধান হন। খালেদেরও সেদিন থেকে অবচেতন মনে সেনাপ্রধান হবার স্বপ্ন জাগে। ১ নভেম্বর থেকেই খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধান হতে মোশতাককে পীড়াপীড়ি করেন। মোশতাক রাজী না হওয়ায় ৪ নভেম্বর ৪৬ বিগ্রেড কমান্ড ঘটায় অভ্যুত্থান। বিগ্রেডিয়ার কামরুল, কর্নেল এটিএম হায়দার, কর্নেল শাফায়াত জামিল, কর্নেল আব্দুল মালেক, লেঃ কর্নেল জাফর ইমাম ও মেজর ইকবাল সেই দলে ছিলেন। সশস্ত্র সৈনিকরা মোশতাক ও মন্ত্রিসভার সদস্যদের হত্যার জন্য অস্ত্র তাক করে।
জেনারেল এম এ জি ওসমানী বঙ্গবন্ধু হত্যার পর টু-টা শব্দটি না করলেও মোশতাকের বুকে যখন অস্ত্র তাক করা হয়, তখন তিনি দৌড়ে ছুটে গিয়ে বলেন, ‘একি করছো, খবরদার, গুলি করো না। এসো আমার সঙ্গে, তোমাদের সব দাবি পূরণ করা হবে। ’
প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা জেনারেল ওসমানী স্তব্ধ বিমূঢ় মোশতাককে বলেন, ‘স্যার, এরা যা চায় তাই করুন। সই করে দিন। এখানে রক্তগঙ্গা বইতে দেয়া যায় না। ’ রাষ্ট্রপতি ঘাড় নেড়ে সম্মতি দেন। ওসমানী সশস্ত্র সেনাকর্মকর্তাদের হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে বলেন, ‘তোমরা যা চাও তাই হবে। এখানে রক্তপাত করে কলঙ্ক সৃষ্টি করো না। ’
টাইপ করা কাগজগুলো রাষ্ট্রপতির সামনে ধরে ওসমানী বললেন, স্যার স্বাক্ষর দিন। মোশতাক নীরবে সই করে দিলেন। এই মূহুর্তে খবর আসে কারাগারে জাতীয় চারনেতা হত্যার। মোশতাকের পতন হয়ে যায় তাতে। ৬ নভেম্বর সেনাপ্রধান খালেদ মোশাররফের পছন্দে প্রধান বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতি হন। জেনারেল খালেদ বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিমানে তুলে দিয়ে পালানোর সুযোগ দিলেন। মোশতাককে নেয়া হল বেতার কেন্দ্রে।
তিনি ভাষণে বলেন, ‘আমার প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা জেনারেল এম এ জি ওসমানীর সংকটকালীন এক ঐতিহাসিক ভুমিকা পরিসমাপ্ত হয়েছে। দৃঢ় চরিত্রের অধিকারী এই কর্মবীর যা করেছেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। ’ বাংলাদেশ জিন্দাবাদ বলে বক্তব্য শেষ করেন মোশতাক। তিনি '৭৬ সালে ডেমোক্রেটিক লীগ গঠন করে পল্টন ময়দানে সমাবেশ করেন। অতর্কিত বোমা হামলা ও সাপ ছেড়ে দেয় সমাবেশ স্থলে। ২ জন সাংবাদিকসহ ৯ ব্যক্তি মারা যান। দুটি দুর্নীতি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে পাঁচবছর কারাদণ্ড ভোগ করেন মোশতাক। ’৯৬ সালে ৫ মার্চ মারা যাবার আগ পর্যন্ত কার্যত তিনি আগামসী লেনের বাড়িতে গৃহবন্দী ছিলেন।
জিয়াকে গৃহবন্দী করে খালেদ সেনাপ্রধান হন। সুখ তারও সইলো না। কর্নেল তাহেরের অভ্যুত্থানে ৭ নভেম্বর ভোরে নিহত হন খালেদ মোশাররফ, বিগ্রেডিয়ার কামরুল হুদা ও কর্নেল এটিএম হায়দার। রাষ্ট্রপতি সায়েম বেতার ভাষণে বলেন, ‘গত ১৫ আগস্ট কতিপয় অবসরপ্রাপ্ত এবং চাকরিরত সামরিক অফিসার এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও তার পরিবার-পরিজনকে হত্যা করে এবং খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করে সামরিক আইন জারী করেন। প্রকৃতপক্ষে এই ঘটনার সঙ্গে সামরিক বাহিনী সংশ্লিষ্ট ছিল না। ’
১৮৭৫ সালে সিরাজউদ্দৌলাকে নবীনচন্দ্র সেন পলাশীর যুদ্ধ কবিতায় লম্পট, ভীরু অমিতচারী হিসাবে চিহ্নিত করেন। যার চারপাশে ভীত ও কামাসক্তে জর্জরিত হারেমের পেশাদার নর্তকীরা পরিবেষ্টিত থাকতো। ১৮৯১ সালে সিরাজউদ্দৌলা গ্রন্থের মাধ্যমে অক্ষয় কুমার মৈত্র এক প্রয়াসের সূচনা করেন যেখানে সিরাজকে একজন জাতীয় বীর হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯০৫ সালে নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ সিরাজউদ্দৌলা নাটকে নবাবকে চিত্রিত করেন বীর হিসেবে।
স্বদেশদ্রোহী মীর জাফর ২৯ জুন মসনদে বসে পুত্র মিরনের হাতে সিরাজকে তুলে দেন। মিরনের নির্দেশে মোহাম্মদী বেগ সিরাজকে হত্যা করে। ১৭৬০ এর ২০ জুলাই মিরন পাটনায় নিজের তাঁবুতে আনন্দ করছিল। হঠাৎ বৃষ্টি-বজ্রপাত। মিরন নর্তকীসহ নিহত হয়। মোহাম্মদী বেগ পানিতে ডুবে মরে।
মোশতাককে কর্নেল তাহের বেতার স্টেশনে দেখে বলেছিলেন, ‘ইফ ইট হ্যাপেনস, আই উইল কাট এভরিবডিস টাং। ’
কর্নেল তাহেরের জাসদ গণবাহিনী ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা জেনারেল জিয়ার মুক্তিদাতা। কিন্তু জিয়াই তাকে দেন ফাঁসি। আবার ’৮১ সালের ৩০ মে জিয়াও নিহত হন।
হিমালয়সম মহীরূহকে হত্যার পর রাষ্ট্রপতির পদে সমাসীন হয়েছিলেন খন্দকার মোশতাক। সূর্যের ধরণীতলে বঙ্গবন্ধু হত্যার অবিশ্বাস্য খবরে বিশ্বাসঘাতকদের মধ্যে প্রথম যে ব্যক্তিটি মুখোশের অন্তরাল থেকে জনসম্মুখে হাজির হন, তিনি খন্দকার মোশতাক আহমেদ। তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু এবং শেষ দুটোই ঘটনাবহুল। মোশতাক বঙ্গবন্ধুর আস্থা অর্জনে কতটা চাটুকারিতার আশ্রয় নিয়েছিলেন, তা তার কয়েকটি ঘটনায় চোখ রাখলে আঁচ করা যাবে।
বঙ্গবন্ধু তার শাসনামলেই নিজের বাবা-মাকে হারান। মা-বাবার কবর হয় গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। বঙ্গবন্ধুর বাবা মৌলভী লুৎফর রহমানের মৃত্যুতে গভীরশোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন মোশতাক। নিজে কবরে নেমে পড়েন লাশের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর মা সায়রা খাতুনের মৃত্যুতে তো মাটিতে গড়াগড়ি করে কান্নায় চোখমুখ ভাসিয়ে ফেলেন। বানিজ্য মন্ত্রী মোশতাকের এ আর্তি সংবাদপত্রের খবর হয়ে যায়।
'৭৫ সালের ১৫ জুলাই শেখ কামালের বিয়েতেও বিশিষ্ট ভুমিকায় অবতীর্ণ হন বাণিজ্যমন্ত্রী মোশতাক। শেখ কামালের উকিল বাপের আসনটি অলংকৃত করেন তিনি। বঙ্গবন্ধুকে একটা সোনার বটগাছ উপহার দিয়ে খন্দকার মোশতাক বলেছিলেন, "মুজিব তুমি সত্যিকার অর্থেই বাংলার বটবৃক্ষ', আমরা হলাম তোমার ডালপালা মাত্র।"
১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট ধূর্ত মোশতাক তার বাসার রান্না করা হাঁসের মাংস নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে হাজির হন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথপোকথনকালে শেখ রাসেলের আগমন ঘটে। মোশতাক শিশু রাসেলকে আদর করে মাথায় চুমো বর্ষণ করেন। নিজের টুপিটা খুলে রাসেলের মাথায় পরিয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টি আকর্ষণ করে মোশতাক বলেন, 'দ্যাখো ওকে কেমন মানিয়েছে।'
সন্ধ্যার পর পরই মোশতাক তার আগামসীহ লেনের বাড়িতে চলে যান। মোশতাক রাতটা দিনে গড়াতেই কী কাণ্ডটা না ঘটালেন! শুধু কী কাণ্ড? না, সেতো বিশ্বাসঘাতকতামূলক এক মহাহত্যাযজ্ঞ। খুনীচক্রের পূর্বপরিকল্পনায় রাষ্ট্রপতি পদ দখল করেন মোশতাক। বঙ্গবন্ধুর লাশটা সিঁড়িতে পড়ে আছে তখনো। বাড়িশুদ্ধ লাশ আর লাশ। ওদিন বায়তুল মোকাররম মসজিদে খুনীদের পক্ষ থেকে জুম্মার নামায আদায়ের পর মিষ্টি বিতরণ করা হয়। সাধারণ মুসল্লিরা বিস্মিত ভীতসন্ত্রস্ত মনে জানলো রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুরই বাণিজ্যমন্ত্রী মোশতাক বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির আসনে।
খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর রাসেলের মাথার ওপর চাপানো তার গাঢ় ছাই রঙের কিস্তি টুপিটাকে জাতীয় টুপি হিসাবে ঘোষণা করে দিলেন। তিনি বলেন, সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের এ টুপি পরিধান করতে হবে। সব মন্ত্রিরা সায় দেন। সেই প্রস্তাব পাস করা হলো এই বলে যে, জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় ফুল, জাতীয় ফল, জাতীয় পাখির মতো একটা জাতীয় টুপিও থাকা দরকার।
মোশতাক অতিশয় ভাগ্যবান ছিলেন। জীবনে বারবার বিশ্বাসঘাতকতা করেও পার পেয়ে যান বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতায়। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতেও মোশতাকের প্রতি পরম ভালবাসা প্রকাশ পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু রাজনীতির প্রথম দিকের ভূমিকা ভুলে গিয়ে মোশতাককে বন্ধু ভেবে বুকে স্থান দিয়েছিলেন।
'৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলে কারারুদ্ধ শেখ মুজিবুর রহমানের পাশাপাশি খন্দকার মোশতাক আহমেদও যুগ্ম সম্পাদক হয়েছিলেন। কিন্তু ওই বছরের ১১ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খানের আগমন উপলক্ষে 'গভর্নর হাউজ' ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করে আওয়ামী মুসলিম লীগ। কর্মসূচি চলাকালীন গ্রেফতার হন দলের সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক এবং পরে শেখ মুজিব।
ভয়ে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে দল ত্যাগ করেন অন্যতম সহ-সভাপতি ঢাকা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন, আলী আমজাদ খান ও সহ-যুগ্ম সম্পাদক এ কে রফিকুল হোসেন। যুগ্ম সম্পাদক মোশতাক রাজনীতির পাট চুকিয়ে আইন ব্যবসায় শামিল হন সিনিয়র সহ-সভাপতি আতাউর রহমান খানের সঙ্গে। '৫০ সালে কারামুক্ত শেখ মুজিব আওয়ামী মুসলিম লীগের অফিস খুলে বসেন নবাবপুরে। ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসাবে শেখ মুজিব দলীয় কার্যক্রম শুরু করলেও মোশতাকের হদিস ছিল না। ফলে ‘৫৩ সালের প্রথম কাউন্সিলে নির্বাচিত কমিটিতে তার ঠাঁই হয়নি।’
‘৫৪ সালের মার্চের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের মনোনয়নলাভে ব্যর্থ হন মোশতাক। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বিশেষ অনুকম্পায় তাকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে বিজয়ী করে আনা হয়। আওয়ামী লীগও তাকে ফিরিয়ে নেয়। আওয়ামী মুসলিম লীগ যুক্তফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে এলেও গভর্নর শেরেবাংলার দলে গা ভাসান এবং চীফ হুইপ হন। '৫৫ সালে দল অসাম্প্রদায়িক নীতিগ্রহণ করে নাম থেকে "মুসলিম" শব্দ কর্তন করলে মোশতাক আব্দুস সালাম খানের সঙ্গে হাত মেলান এবং আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে দল টিকিয়ে রাখেন। তারা বহিষ্কারও হন। পরে মোশতাক আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন।
'৭১ সালে মুজিব নগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোশতাক পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গঠনের চক্রান্তের দায়ে অভিযুক্ত হন। হারান মন্ত্রীত্ব। আর সেই মধুর প্রতিশোধ নেন '৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জাতীয় চারনেতাকে হত্যা করে। রাষ্ট্রপতির ভাষণে মোশতাক বঙ্গবন্ধুর খুনীদের 'দেশের সূর্য সৈনিক' হিসাবে অভিহিত করেন।
আওয়ামী লীগ একুশ বছর পর '৯৬ সালের ২৩ জুন ক্ষমতায় ফিরে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চারনেতা হত্যার বিচার কার্য শুরু করে। ভাগ্যিস মোশতাক তার আগেই মারা যান। পুলিশ পাহারায় বায়তুল মোকাররম মসজিদ প্রাঙ্গণে মোশতাকের লাশ এনে নামাজে জানাজা করতে চাইলেও গণবিক্ষোভের মুখে সম্ভব হয়নি। কুমিল্লার দাউদকান্দির দশপাড়ায় পারিবারিক কবরস্থানে মোশতাককে দাফন করা হয়। সব কবরে নামফলক থাকলেও নেই মোশতাকের কবরে। মোশতাকের ছেলে ইশতিয়াক আহমেদ থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। আর দুই মেয়ে শিরিন সুলতানা ও ডাঃ নাজনীন সুলতানা যুক্তরাজ্যে। তারা জনরোষের ভয়ে বাড়িতে আসছেন না। পরিত্যক্ত এখন সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা মোশতাকের বাড়িটি।
আগেই বলেছি খন্দকার মোশতাক ২১ বছর বাড়ির চার দেয়ালে বন্দী ছিলেন। দুরারোগ্যে ভুগতে ভুগতে ’৯৬ সালের ৫ মার্চ মারা যান। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মোশতাক আসামি হলেও মৃত বলে আদালত তার নাম বাদ দেয়। যদিও মরণোত্তর বিচারেরও সুযোগ ছিলো।
নামাজে জানাজার জন্য পুলিশ পাহারায় মোশতাকের লাশ বায়তুল মোকাররম মসজিদ প্রাঙ্গণে আনার চেষ্টা করা হলেও বিক্ষোভের মুখে তা সম্ভব হয়নি। দাউদকান্দিতে কবর দেয়া হলেও নেই কোনো নামফলক। মোশতাকের বাড়িটিও পরিত্যক্ত। এক ছেলে যুক্তরাষ্ট্রে আর দুই মেয়ে আছে যুক্তরাজ্যে। নিয়তির কী বিধান জনরোষের আতঙ্কের কারণে বাবার কবর দেখতেও তারা দেশে ফিরতে পারেন না। অথচ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মাজারকে ঘিরে কতশত মানুষের প্রার্থনা। তিনি বঙ্গবন্ধু শুধু নিজ স্বদেশে নয়, জাতিসংঘের মূল্যায়নে ‘বিশ্ববন্ধু’।
নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে খোশবাগে আলীবর্দি খানের পাশেই কবর দেয়া হয়। তিনিও ইতিহাসের বীরনায়ক। ১৭৫৭ সালের ২৯ জুন মসনদে বসা মীর জাফর ক্ষমতা হারিয়ে কুষ্ঠরোগে মরে থাকেন রাস্তায়। যেদিন সিরাজের মস্তকহীন লাশ হাতিতে চড়িয়ে রাজধানী মুর্শিদাবাদের অলিগলি প্রদক্ষিণ করছিল সেই দিনটি সম্পর্কে পলাশীর খলনায়ক লর্ড ক্লাইভ লিখেছেন, ‘কয়েক লাখ লোক দর্শক হলো তারা চাইলে শুধু লাঠি ও ঢিল দিয়ে ইংরেজ সৈন্যদের মেরে ফেলতে পারতো।’
সাধারণ আদালতের বিচারের চেয়েও প্রকৃতির বিচার বড় বেশি নিষ্ঠুর, বেশি নির্মম। তাই তো কুষ্ঠ রোগে মরেছেন বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর আলী খান। কপর্দকহীন অবস্থায় মারা গেছেন উর্মি চাঁদ। নন্দ কুমার ঝুলেছেন ফাঁসিতে। জগৎ শেঠ ও তার পিতৃব্যপুত্র মহারাজা স্বরূপচাঁদকে মারা হয়েছে গঙ্গা নদীতে ডুবিয়ে। উম্মাদ অবস্থায় কুয়ায় ঝাঁপ দিয়ে মরেছে নবাবের ঘাতক মোহাম্মদী বেগ। কারাগারে মারা যান রায়দুর্লভ। ইয়ার লতিফ নিখোঁজ হয়ে যান চিরদিনের জন্য। পীরজাদা দানা শাহের মৃত্যু হয় সাপের কামড়ে। ক্লাইভ আত্মহত্যা করেন টেমস নদীতে ঝাঁপ দিয়ে। ওয়ারেন হেস্টিংসের শেষ জীবন চলে অপরের করুণার ওপর। বঙ্গবন্ধুর খুনীদেরও ফাঁসি হয়েছে। ইতিমধ্যেই ফারুক, হুদা, মহিউদ্দিন-পাশারা ঝুলেছেন ফাঁসিতে। বাকি খুনিরা পালিয়ে বিদেশের মাটিতে। লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, ঢাকাপ্রেস২৪.কম,সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস বিশেষজ্ঞ