সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একদিনে ১২টি মৃত্যুদণ্ডের (ডেথ রেফারেন্স) মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের অবকাশকালে প্রধান বিচারপতির বিশেষ উদ্যোগে এসব মামলার বেঞ্চ গঠনের পর একসঙ্গে বুধবার (৩০ মার্চ) এত মামলার নিষ্পত্তি হলো।আর এতে বাদীপক্ষ যেমন দ্রুত ন্যায় বিচার পেল তেমনি কনডেম সেলে বন্দি কয়েদিদের ন্যায় বিচার নিশ্চিত হলো বলে মনে করছেন আইনজ্ঞরা।
এই ১২ মামলার ৩৩ আসামির মধ্যে বিচারিক আদালত ২০১৬ সালের বিভিন্ন তারিখে ৩২ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং এক আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন। পরে নিয়ম অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য মামলাগুলো হাইকোর্টে আসে। পাশাপাশি আসামিরা ফৌজদারি আপিল ও জেল আপিল করেন।
শুনানি শেষে হাইকোর্ট ১২টি মামলার নিষ্পত্তি করে ৩২ মৃত্যুদণ্ডের আসামির মধ্যে চারজনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে দুই আসামিকে খালাস দিয়েছেন। বাকি ২৬ আসামিকে সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন। আর যাবজ্জীবন দণ্ডিত আসামীর দণ্ড বহাল রেখেছেন।
এর আগে হাইকোর্টের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো গত ৯ মার্চ প্রধান বিচারপতি মৃত্যুদণ্ডের মামলা শুনানির জন্য ১১টি বেঞ্চ গঠন করে দেন। ২০ মার্চ রোববার থেকে ৩১ মার্চ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অবকাশকালীন সময়ে এসব বেঞ্চে শুনানির জন্য ৫২টি মামলার তালিকাও প্রকাশ করে।
অ্যাটির্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন জানান, অতীতে কখনো একসাথে এতগুলো ডেথ রেফারেন্স বেঞ্চ ছিল না। প্রধান বিচারপতি অবকাশকালীন এই বন্ধটাকে কাজে লাগিয়েছেন। ডেথ রেফারেন্সের বেঞ্চ গঠন করে দিয়ে গত দুই সপ্তাহে ৩০টিরও বেশি মামলার নিষ্পত্তি করেছেন। এর ফলে বিচারপ্রার্থী মানুষ কিছুটা হলেও প্রতিকার পেয়েছেন। বলা যায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত হলো।
বুধবার যেসব মামলার নিষ্পত্তি করা হয়
২০১৩ সালের ১৪ মার্চ ঢাকার খিলগাঁওয়ে যৌতুক না দেওয়ায় কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে স্ত্রী পলি আক্তারকে হত্যার অপরাধে বিচারিক আদালত স্বামী ফারুক সিকদারকে মৃত্যুদণ্ড দেন। এ মামলায় ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানি শেষে আসামির সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন বিচারপতি এস এম এমদাদুল হক ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ার কাজলের হাইকোর্ট বেঞ্চ।
২০১৫ সালে তাস খেলাকে কেন্দ্র করে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার ছোট লতিফপুর এলাকায় কলেজ ছাত্র মাসুদ রানা (১৭) হত্যার দায়ে তারই দুই বন্ধু মো. পারভেজ ও অমিত হাসানকে বিচারিক আদালত মৃতুদণ্ডাদেশ দেন। শুনানি শেষে আসামিদের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন হাইকোর্টের একই বেঞ্চ।
২০১৫ সালের ১৩ অক্টোবর গাজীপুরে দশম শ্রেণীর স্কুলছাত্রী কবিতা মনি দাসকে হত্যার দায়ে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বিক্রম চন্দ্র সরকারকে।
শুনানি শেষে আসামির সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন হাইকোর্টের একই বেঞ্চ।
২০১৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পিরোজপুরের নাজিরপুরে মামা হেমলালকে খুনের দায়ে ভাগ্নে নিবাস চন্দ্র শীলকে মৃত্যুদণ্ড দেন বিচারিক আদালত। হাইকোর্টের একই বেঞ্চ শুনানি শেষে নিবাসের সাজা কমে যাবজ্জীবন দিয়েছেন।
২০১৪ সালের ১৫ আগস্ট বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে অপরহণ করে মুক্তিপণ না পেয়ে গাজীপুরের শ্রীপুরে নারী পোশাক শ্রমিক রূপালী খাতুনকে (২৫) হত্যার দায়ে দুই আসামির মৃত্যুদণ্ড এবং দুই আসামিকে যাবজ্জীবন সাজা দেন বিচারিক আদালত।
শুনানি শেষে বিচারপতি মো. ইকবাল কবির ও বিচারপতি মো. কামরুল হোসেন মোল্লার বেঞ্চ দুই জনের মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন দণ্ড দেন। একইসঙ্গে যাবজ্জীবন দণ্ডিত বাকী দুই জনের সাজা বহাল রাখেন।
বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতরা হলেন, শ্রীপুর উপজেলার বরমী কাদীরাপাড়ার আব্দুল হেকিম মিয়ার ছেলে আবুল কালাম (৩২) ও একই এলাকার হাছেন আলীর ছেলে মো. ইকবাল হোসেন (২৫)। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- ওই এলাকার ছবুর উদ্দিনের ছেলে আব্দুল লতিফ (২৬) ও মফিজ উদ্দিনের ছেলে মো. মোখলেছ মিয়া (২১)।
নিহত রুপালী খাতুন রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার মারিয়া গ্রামের মকবুল হোসেনের মেয়ে।
২০০৬ সালে জয়পুরহাট সদরের ধারকী গ্রামের আব্দুল মতিন হত্যা মামলায় বিচারিক আদালত সাত আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং এক আসামিকে যাবজ্জীবন দণ্ড দেন।
শুনানি শেষে এক জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে ছয় জনকে যাবজ্জীবন দিয়েছেন হাইকোর্টের একই বেঞ্চ। পাশাপাশি যাবজ্জীবন দণ্ডিত আসামি মাহবুব আলম বাবুর সাজা বহাল রেখেছেন।
মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা আসামি জয়পুরহাট সদরের ধারকী গ্রামের মো. মাজিরউদ্দিন। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া আসামিরা হলেন- একই গ্রামের ওয়াজেদ আলী ওরফে তোরাফ, মো. চৈতুন মোল্লা, ছাবাদুল, মো. আনু, আবু হাসান দিলীপ, মন্টু মিয়া।
২০০৮ সালের ১৭ মার্চ বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার ডেউয়াতলা গ্রামে অখিল বৈরাগীকে হত্যার দায়ে তার ভাই ভবসিন্ধু বৈরাগীকে বিচারিক আদালত মৃত্যুদণ্ড দেন।
এ মামলার শুনানি শেষে বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান ও বিচারপতি মুহম্মদ মাহবুব-উল ইসলামের বেঞ্চ তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন।
২০১৫ সালের ২৭ আগস্ট নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার জোয়ারী ইউনিয়নের কামারদহ গ্রামে শিশু ইয়াসিন আরাফাত ইমন(৮) হত্যায় বাবা ইমদাদুল হক মিলন ও সৎ মা নাহিদা বেগমকে মৃত্যুদণ্ড দেন বিচারিক আদালত।
শুনানি শেষে হাইকোর্টের এই বেঞ্চ তাদের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন দণ্ড দেন।
২০১৪ সালের ১৭ মে বগুড়ায় দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র শাহরিয়ার নাফিজ সিয়ামকে অপহরণ, মুক্তিপণ দাবি ও হত্যার দায়ে আল আমিন সোহাগ নামে এক যুবককে বিচারিক আদালত মৃত্যুদণ্ড দেন। শুনানি শেষে হাইকোর্টের একই বেঞ্চ সোহাগের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।
২০০৬ সালে গাজীপুরের টঙ্গীর এরশাদ নগরে চাঁদার দাবিতে মোকছেদ আলী সেন্টু নামের এক ব্যবসায়ীকে হত্যার দায়ে বিচারিক আদালত চার আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেন।
বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল করিম ও বিচারপতি সরদার মো. রাশেদ জাহাঙ্গীরের হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানি শেষে আসামিদের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন ।
দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন টঙ্গীর এরশাদ নগর এলাকার মো. রুবেল ওরফে টাইগার রুবেল (৩৫), একই এলাকার বাবু (৩২) ও আশরাফ আলী (৩০) এবং টঙ্গীর আউচপাড়া এলাকার ছলেমান (৩১)।
২০০৮ সালের ৯ মার্চ শিক্ষানবিশ আইনজীবী ফিরোজ্জামান ওরফে সোহেলকে (২৮) গাজীপুরের দক্ষিণ ছায়াবিথী এলাকায় কুপিয়ে জখম করা হয়। পরদিন হাসপাতালে নেওয়া হলে তার মৃত্যু হয়। বিচারিক আদালত এই মামলায় ৫জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন।
শুনানি শেষে একই পরিবারের দুই জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন বিচারপতি মো. রেজাউল হাসান ও বিচারপতি কাজী ইবাদত হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ।
ওই পরিবারের আরও দুই সদস্যের মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে কমিয়ে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়। এছাড়া এক আসামিকে খালাস দেন।
পাঁচ আসামি হলেন-আমেনা বেগম ও তার তিন ছেলে তিথী, সজল ও বাপ্পী। আরেকজন আমেনা বেগমের বোনের ছেলে বাদল। এর মধ্যে তিথী ও সজলের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। আমেনা ও বাপ্পীর সাজা পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন এবং বাদলকে খালাস দিয়েছেন উচ্চ আদালত।
২০১৩ সালের ২৬ মে সন্ধ্যা নরসিংদী শহরে ছয় বছরের শিশু হাসিবুল হাসান অয়নকে অপরহরণ করে হত্যার দায়ে পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন বিচারিক আদালত।
শুনানি শেষে বিচারপতি মো. হাবিবুল গনি ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ তিন আসামিকে সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন দেন। আর এক আসামিকে সাত বছরের কারাদণ্ড এবং একজনকে খালাস দেন।
৫ আসামির মধ্যে সজিব খান (২২), শাকিল মিয়া (১৮), ইমরানকে (২০) যাবজ্জীবন দেওয়া হয়। শামীম ওসমানকে (১৯) সাত বছর এবং রুবেল মিয়াকে (১৮) খালাস দেন।
আইনজীবীরা বলছেন,আসামীদের কম বয়স বিবেচনা,চাক্ষুষ সাক্ষী না থাকা, সাক্ষীদের পরস্পরবিরোধী সাক্ষ্যের কারণে আসামীদের দণ্ড কমিয়েছেন হাইকোর্ট। আর সম্পৃক্ততা প্রমাণিত না হওয়ায় দুইজনকে খালাস দিয়েছেন।