এক সময়ের সচল পঞ্চগড় চিনিকল এখন পরিত্যক্ত অবকাঠামোতে পরিণত হয়েছে। বিশালাকার আখ চাষের মাঠ যেন বিরানভূমি। বছরের এক-তৃতীয়াংশ সময়জুড়ে চিনি উৎপাদন হলেও বছরজুড়েই ছিল শ্রমিক-কর্মচারীদের উৎসবমুখর পদচারণা। সে সময় এ চিনিকলে এক হাজার চারশ’র বেশি শ্রমিক-কর্মচারী কর্মরত ছিলেন। ২০২০-২১ আখ মাড়াই মৌসুমে আকস্মিক দেশের ছয়টি চিনিকলের সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় পঞ্চগড়ের একমাত্র ভারী এ শিল্পকারখানা।
পঞ্চগড় চিনিকল বন্ধ ঘোষণার পর বেকার হয়ে পড়েন শ্রমিক-কর্মচারীরা। চিনিকলে কর্মরত বেশিরভাগ শ্রমিক-কর্মচারী দেশের বিভিন্ন চিনিকলে বদলি করা হলেও বর্তমানে পঞ্চগড় চিনিকলে প্রায় ৮০ জন শ্রমিক-কর্মচারী রয়েছেন। কিন্তু চার মাস ধরে তাদের কাজ নেই, বেতনও বকেয়া। কাজ এবং বেতন না পেয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। চাকরিজীবন শেষ করে অবসরপ্রাপ্তদেরওপাওনার জন্য দিনের পর দিন ঘুরতে হচ্ছে।
বন্ধ ঘোষণার পর পঞ্চগড়ে উৎপাদিত আখ পাশের জেলা ঠাকুরগাঁও চিনিকলে সরবরাহ করা হয়। তবে সময়মতো ঠাকুরগাঁও চিনিকলে আখ সরবরাহ করতে না পারায় লোকসান গুনতে হয়েছে চাষিদের। এজন্য আখ চাষিরা জমিতে ধান, গম, ভুট্টাসহ বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদন শুরু করেছেন।
চিনিকলের ১০০ একর আবাদি জমি স্থানীয় কৃষকদের মাঝে অস্থায়ীভাবে লিজ দেওয়া হয়। মৌসুমে এসব জমিতে আখচাষ না করে তরমুজ, লাউ, শিমসহ বিভিন্ন শস্য আবাদ করা হয়। এরপর তাদের লিজ বাতিল করে আখচাষের শর্তে দুজনকে আবারও টেন্ডারের মাধ্যমে অস্থায়ী লিজ দেওয়া হয়। এদের মধ্যে মাহফুজ আলম মুরাদ নামের স্থানীয় এক আখচাষি ৩৫ একর ও জয়পুরহাটের এক কৃষক ৬৫ একর জমি লিজ নেন। কিন্তু এবারও জমিতে তারা নামমাত্র আখ চাষ করে বাকি জমিতে টমেটো, ভুট্টা, শসাসহ বিভিন্ন ধরনের শস্য আবাদ করেছেন।
স্থানীয় আখচাষি মাহফুজ আলম মুরাদ বলেন, এক বছরের জন্য একরপ্রতি ১৮ হাজার টাকা চুক্তিতে ৩৫ একর জমি পঞ্চগড় চিনিকল থেকে লিজ নিই। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী চিনিকল থেকে সময়মতো বীজ না পেয়ে ২০ একর জমিতে টমেটো, শসা, তরমুজ ও ভুট্টা আবাদ করেছি। বাকি ১৫ একর জমিতে আখচাষ করেছি।
এছাড়া জয়পুরহাটের এক কৃষককে একরপ্রতি ১৭ হাজার টাকা করে ৬৫ একর জমি লিজ দেওয়া হয়েছে। তিনিও বেশির ভাগ জমিতে আখ চাষ করেছেন। আখসহ বিভিন্ন ফসলে এ পর্যন্ত আমার সাত লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে।
পঞ্চগড় চিনিকল সূত্র জানায়, ১৯৬৬ সালে শুরু হয় পঞ্চগড় চিনিকল প্রতিষ্ঠার কাজ। এরপর এক হাজার ১৬ টন আখ মাড়াই ক্ষমতা নিয়ে ১৯৬৯-৭০ মাড়াই মৌসুমে প্রতিষ্ঠিত জেলার একমাত্র এ ভারী শিল্পকারখানা। তবে কাঁচামাল (আখ) সরবরাহের অভাব এবং চিনিকলের অধিকাংশ যন্ত্রপাতি পুরোনো হওয়ায় উৎপাদন কমে যায়। এরপর পঞ্চগড় চিনিকলে প্রতি বছর লোকসানের পরিমাণ বাড়তে থাকে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৫২ উৎপাদন মৌসুমের মধ্যে মাত্র ১৭ মৌসুমে মুনাফা করেছিল এ প্রতিষ্ঠান। এজন্য ২০২০-২১ মাড়াই মৌসুমে চিনিকলের আখ মাড়াই এবং চিনি উৎপাদন কার্যক্রম স্থগিত করে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন। বর্তমানে চিনিকলে কোনো চিনি মজুত না থাকলেও ৭৭৮ টন মোলাসেস মজুত রয়েছে। প্রতি টন ৩২ হাজার টাকা করে এ মোলাসেসের মূল্য দুই কোটি ৪৮ লাখ ৯৬ হাজার টাকা।
২০২০-২১ মৌসুমে পঞ্চগড় চিনিকলের আওতায় জেলায় তিন হাজার ৮০৫ একর জমিতে আখচাষ করা হয়েছিল। মাড়াই মৌসুমে ৪৮ হাজার টন আখ সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। কিন্তু পঞ্চগড় চিনিকলে আখ মাড়াই বন্ধ থাকায় কৃষকদের পঞ্চগড়ে উৎপাদিত আখ ঠাকুরগাঁও চিনিকলে সরবরাহ করতে হয়। কিন্তু সময়মতো ঠাকুরগাঁও চিনিকলে আখ সরবরাহ করতে না পেরে ক্ষতিগ্রস্ত হন আখচাষিরা। ২০২১-২২ আখ মাড়াই মৌসুমে পঞ্চগড় চিনিকলের জমিতে চাষের সাত হাজার ৫৪৩ টন আখ ঠাকুরগাঁও চিনিকলে সরবরাহ করা হয়।
২৪৭ কোটি ৮৭ লাখ ৯৪ হাজার টাকা দেনা নিয়ে গত বছরের ৩১ মে পঞ্চগড় চিনিকলের প্রায় ৮০০ শ্রমিক-কর্মচারীর মধ্যে ২৪৮ জন চুক্তিভিত্তিক শ্রমিককে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এসব চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে চিনিকলে চাকরি করেছিলেন। হঠাৎ করে চিনি ও খাদ্য করপোরেশনের আদেশে তাদের বাদ দেওয়ায় পুরোপুরি বেকার হয়ে পড়েন তারা। বাকি শ্রমিক-কর্মচারীদের ক্রমান্বয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় চালু থাকা চিনিকলে বদলি করা হয়। বর্তমানে পঞ্চগড় চিনিকলে চুক্তিভিত্তিক নিরাপত্তাকর্মীসহ শ্রমিক-কর্মচারীর সংখ্যা ১০৮ জন। এদের মধ্যে ১২ জন কারখানা শ্রমিকসহ ৬০ জন শ্রমিক-কর্মচারী চিনিকলের বিভিন্ন শাখায় কর্মরত।
চাকরিজীবন শেষে ২৮০ জন অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক-কর্মচারী তাদের অবসর ভাতার টাকা (গ্র্যাচুইটি) পেতে দিনের পর দিন ঘুরছেন মিল চত্বরে।
পঞ্চগড় চিনিকলের আখ উন্নয়ন সহকারী (সিডিএ) মো. মনিরুজ্জামান বলেন, পুনরায় চালুর কথা বলে সরকার মিলটি বন্ধ করে রেখেছে। আমরা কোনো বেতন পাচ্ছি না। ২০২১ সালের বেতন এখনও বকেয়া। ইতোমধ্যে যাদের বাইরে বদলি করা হয়েছে তাদেরও নাকি তিন-চার মাসের বেতন বাকি।
কারখানার পাম্প অপারেটর ওমর ফারুক বলেন, নিয়মিত অফিসে যাতায়াত করছি। কিন্তু বেতন পাচ্ছি না। বর্তমানে আমার চার মাসের বেতন বকেয়া। প্রতিদিন ১০-১৫ জন করে অবসরপ্রাপ্তরা মিলে এসে ঘোরাঘুরি করেন। এখন পর্যন্ত তাদের অবসরের টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে না।
কারখানার টারবাইন অপারেটর আশরাফুল আশর বলেন, সাময়িক স্থগিতের কথা বলে গত বছর আখ মাড়াই মৌসুমে আকস্মিক চিনিকলটির আখ মাড়াই স্থগিত করা হয়। বলা হচ্ছিল আবার চালু হবে। তবে কখন হবে- আমরা জানি না।
পঞ্চগড় চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) খুরশীদ জাহান মাফরুহা বলেন, বন্ধ নয়, কাঁচামাল সরবরাহের অভাব এবং পুরোনো যন্ত্রপাতির জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে মিলটির উৎপাদন কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়েছে। স্বল্প সংখ্যক জনবল নিয়ে মিলের অন্য কার্যক্রম চলমান।