দেশে সরকারি পর্যায়ে বেড়েছে চালের মজুত। গত বছরের তুলনায় মজুত বেড়ে হয়েছে তিনগুণের বেশি। বর্তমানে মাঠপর্যায়ে সরকারি চালের বিতরণ স্বাভাবিক থাকলেও বোরো মৌসুম এগিয়ে আসছে। চালের পাশাপাশি মজুত বেড়েছে গমেরও। বর্তমানে চাল ও গম মিলে সরকারিভাবে খাদ্যশস্যের মজুত দাঁড়িয়েছে (২৩ মার্চ পর্যন্ত) ১৭ লাখ টনের বেশি। গত বছরের এই সময়ে মজুতের পরিমাণ ছিল মাত্র সোয়া পাঁচ লাখ টনের কাছাকাছি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মজুত বাড়ায় চলতি বছরে সংগৃহীত খাদ্য নিয়ে বিপাকে পড়তে পারে খাদ্য বিভাগ। তবে খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, চালের মজুত বাড়লেও তাতে সমস্যা নেই। চাল সংরক্ষণে আধুনিকায়নের কারণে মজুত থাকলেও যেমন নষ্ট হওয়ার সুযোগ নেই, তেমনি ওএমএসসহ মাঠ পর্যায়ের বিতরণ বাড়ানোর নানা পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নাজমানারা খানুম বলেন, অন্য বছরের তুলনায় এবার আমাদের স্টক (মজুত) অনেক বেড়েছে। আমরা মূলত অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের দিকে বেশি জোর দিয়েছি। এবছর চালের আমদানি কম।
চালের মজুত বাড়তি থাকায় দুশ্চিন্তা নেই জানিয়ে খাদ্য বিভাগের এই অভিভাবক বলেন, গত বছর যখন স্টক (মজুত) কম ছিল, তখন দুশ্চিন্তা ছিল। এখন স্টক বেশি থাকায় দুশ্চিন্তা নেই।
চালের উচ্চ মজুত কমানোর পরিকল্পনার বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা ৬০ লাখ লোককে ১০ টাকা কেজিতে চাল দেই। আগামী সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর- তিন মাসে আমাদের প্রায় দুই লাখ টন চাল প্রয়োজন হবে। গত বছর স্টক (মজুত) কম ছিল। তখন টিআর, কাবিখাকে টাকায় কনভার্ট (রূপান্তর) করে দিয়েছিলাম। এবার টিআর-কাবিখাকে নিয়মমাফিক দেওয়া হবে। আরও ব্যাপকভাবে বাড়ানো হবে ওএমএস।
বেশিদিন মজুত থাকলেও চাল নষ্ট হবে না দাবি করে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেন, আমনের মজুত ভালো। আমন চাল আর্দ্রতা সহিষ্ণু। এ মৌসুমের চাল সহজে নষ্ট হয় না। তারপরও আমরা আমাদের গোডাউনগুলোতে বায়ুরোধক ব্যবস্থা করছি। কিছু আধুনিক খাদ্যাগার করছি।
তবে খাদ্য অধিদপ্তরের প্রতিবেদন ও সচিবের বক্তব্যে ভিন্নতা পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত দুই মৌসুমে (বোরো ও আমন) সবমিলিয়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে চার লাখ ২৭ হাজার ১৮১ টন চাল সংগ্রহ কম হয়েছে। চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরে আমন সংগ্রহ মৌসুমে (২৮ ফেব্রুয়ারি শেষ হওয়া পর্যন্ত) তিন লাখ টন ধান (আমন মৌসুমে ০.৬৬৪৫৮ হিসেবে এক লাখ ৯৯ হাজার ৩৭৪ টন) এবং সাত লাখ ২০ হাজার টন সিদ্ধচাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত ছিল খাদ্য বিভাগের। সবমিলিয়ে নয় লাখ ১৯ হাজার ৩৭৪ টন সংগ্রহ করার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও আমন মৌসুমে চাল সংগ্রহ হয়েছে সাত লাখ ৬৮ হাজার ১৪১ মেট্রিক টন। হিসাব অনুযায়ী মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এক লাখ ৫১ হাজার ২৩৩ টন কম সংগ্রহ হয়েছে। গত বছর চালের এ সংগ্রহ আরও কম হয়েছিল।
গত বোরো মৌসুমেও চাল সংগ্রহ কম হয়েছে। বোরো মৌসুমে (৩১ আগস্ট শেষ হওয়া পর্যন্ত) সাড়ে ছয় লাখ টন ধান ও ১২ লাখ ৩৫ হাজার টন চাল সংগ্রহ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত ছিল। সবমিলিয়ে বোরো মৌসুমে শূন্য দশমিক ৬৫ হিসাবে সাড়ে ছয় লাখ টন ধানে চার লাখ ২২ হাজার ৫০০ টন চাল ধরে মোট ১৬ লাখ ৫৭ হাজার ৫০০ টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু মোট চাল সংগ্রহ হয়েছে ১৩ লাখ ৮১ হাজার ৫৫২ টন। এতে সদ্য বিদায়ী বোরো মৌসুমে দুই লাখ ৭৫ হাজার ৯৪৮ টন চাল কম সংগ্রহ হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সংগ্রহ কম হলেও আমদানিও হয়েছে সমানতালে। এতে চলতি অর্থবছরে চালের আমদানি বেশি হওয়ায় হু হু করে বেড়েছে মজুত।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে খাদ্য বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, গত বছর মজুত কম ছিল। তখন আমদানি বাড়ানো হয়েছে। ওই কার্যাদেশের চাল এখনো আসছে। সামনে রমজানের পরপরই নতুন করে বোরো সংগ্রহ মৌসুম শুরু হবে।
এ কর্মকর্তা বলেন, খাদ্যশস্য এমন পণ্য যা স্টক করেও বেশিদিন রাখা যায় না। সুষম আমদানির পাশাপাশি বণ্টনেরও সুষম ব্যবস্থা থাকতে হবে। অন্যথায় সমস্যায় পড়তে হবে মজুত নিয়ে।
জানা যায়, করোনাকালীন ফলন বিপর্যয়ের কারণে ও সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে খোলা বাজারে চালের দাম বাড়তি থাকায় গত অর্থবছরে (২০২০-২০২১) লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চাল সংগ্রহ করতে পারেনি খাদ্য বিভাগ। অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে গত বছর সরকারি খাদ্যের মজুত কমে যায়। এতে দেশের বাজারে বাড়তে থাকে চালের দাম। পরে দ্রুত চাল আমদানির পদক্ষেপ নেয় সরকার। জিটুজি (সরকারের সঙ্গে সরকারের) পর্যায়ে আমদানির পাশাপাশি উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমেও সরকার চাল সংগ্রহ করে। আবার ব্যক্তিখাতের সাধারণ ব্যবসায়ীদের চাল আমদানির সুযোগ করে দেয় সরকার। এতে চলতি (২০২১-২০২২) অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম সংগ্রহ হলেও আমদানি বেড়েছে। ফলে বেড়েছে মজুতও। তবে বাজারে চালের দাম কমেনি।
চাল-গমের মজুত বেড়েছে তিন গুণ, সংরক্ষণ নিয়ে শঙ্কা
খাদ্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরের প্রথম আট মাস ২৩ দিনে (১ জুলাই ২৩ মার্চ পর্যন্ত) মোট ৪০ লাখ ১৬ হাজার ৯০০ মেট্রিন টন খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে নয় লাখ ৫৮ হাজার ৩২০ টন চাল এবং ৩০ লাখ ৫৮ হাজার ৫৮০ মেট্রিক টন গম। একই সময়ে সরকারিভাবে খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছে ১০ লাখ ৯৪ হাজার ২৯০ মেট্রিক টন। এতে চাল আমদানি হয়েছে ছয় লাখ ৫২ হাজার ৬৬০ মেট্রিক টন এবং গম আমদানি হয়েছে চার লাখ ৪১ হাজার ৬৩০ মেট্রিক টন। সবমিলিয়ে বর্তমানে (২৩ মার্চ পর্যন্ত) সরকারিভাবে খাদ্যের মজুত দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ চার হাজার ৩৭০ মেট্রিক টনে। এর মধ্যে চালের মজুত (ধানসহ) ১৫ লাখ এক হাজার ৪৮০ মেট্রিক টন এবং গমের মজুত দুই লাখ নয় হাজার ১৮০ মেট্রিক টন। অথচ গত অর্থবছরের (২০২০-২০২১) একই সময়ে সরকারি খাদ্যশস্যের মজুত ছিল পাঁচ লাখ ২৭ হাজার ৬১০ মেট্রিক টন। এর মধ্যে চালের মজুত (ধানসহ) ছিল চার লাখ ৪৯ হাজার ৩০০ মেট্রিক টন এবং গমের মজুত ছিল মাত্র ৭৫ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর আজম বলেন, বছরের শুরুতে চালের দাম বেশি থাকলেও বর্তমানে বাজারে চালের দাম কমছে। সরকারি মজুত বেশি থাকলেও বাজারে তেমন প্রভাব পড়বে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট লাখ ১০ হাজার ২৯০ মেট্রিক টন চালের ঋণপত্র খোলা হয়েছে। আগের অর্থবছরের ঋণপত্রসহ এই সময়ে ১০ লাখ ১০ হাজার ৭৮০ টন চালের ঋণপত্র সমাপ্ত হয়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই মাসে ৫০ হাজার ৭০ মেট্রিক টন, আগস্টে তিন লাখ ৭০০ মেট্রিক টন, সেপ্টেম্বরে চার লাখ ৩০ হাজার ২০০ মেট্রিক টন, অক্টোবরে ২৫ হাজার ৮৬০ মেট্রিক টন, নভেম্বরে ৮৪০ মেট্রিক টন, ডিসেম্বরে এক হাজার ৫৭০ মেট্রিক টন, জানুয়ারিতে ৭২০ মেট্রিক টন এবং ফেব্রুয়ারিতে মাত্র ৩৩০ মেট্রিক টন চালের জন্য ঋণপত্র খুলেছেন ব্যবসায়ীরা।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রোববার (২৭ মার্চ) চট্টগ্রামের খুচরা বাজারে প্রতি কেজি সরু চাল ৭০-৭৬ টাকা, মিনিকেট ৬৬-৭২ টাকা, মাঝারি মানের চাল ৪৮-৫৫ টাকায়, মোটা চাল ৪২-৪৬ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এক মাস আগেও চালের দাম একই ছিল বলে অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। তবে গত বছরের (২০২১ সালের) একই সময়ে মোটা ও মাঝারি মানের চালের দাম কেজিপ্রতি ২-৩ তিন টাকা বেশি থাকলেও সরু চালের দাম কেজিতে ৮-১২ টাকা কম ছিল।
এদিকে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবি বলছে, বাজারে নাজিরশাইল ও মিনিকেট জাতের চাল ৬০-৭০ টাকা, পাইজাম কিংবা লতা জাতের মাঝারি মানের চাল ৫০-৫৬ টাকাং এবং স্বর্ণ কিংবা চায়না ইরি জাতের মোটা চাল ৪৫-৪৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।