রাজনৈতিক অঙ্গনে জাতীয় সংসদ, সিটি করপোরেশন, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের প্রতি দেশবাসীর ব্যাপক আগ্রহ থাকে। এর পাশাপাশি মানুষ আগ্রহী দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির (বার অ্যাসোসিয়েশন) নির্বাচন নিয়েও। সুপ্রিম কোর্ট বারের ১০ হাজার সদস্যের অভিভাবক কারা হচ্ছেন, বিএনপি নাকি আওয়ামী লীগ, কাদের হাতে যাচ্ছে দেশের আইনজীবীদের সবচেয়ে শক্তিশালী এ বারের নেতৃত্ব, তা জানতে উৎসুক থাকে মানুষ।
এক বছর পরপর সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ বছর সুপ্রিম কোর্ট বারের ভোট হবে আগামী ১৫ ও ১৬ মার্চ। সেজন্য শেষ সময়ে এসে নিজেদের পক্ষে ভোটারদের টানতে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির প্যানেলের আইনজীবী নেতারা।
আসন্ন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ২০২২-২০২৩ সেশনের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ (আওয়ামী লীগ সমর্থিত সাদা প্যানেল) প্রার্থী ঘোষণা করে ২৭ ফেব্রুয়ারি। তারা সভাপতি প্রার্থী হিসেবে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির ও সম্পাদক পদে অ্যাডভোকেট আব্দুন নূর দুলালের নাম ঘোষণা করে। এরপর ২ মার্চ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য প্যানেল (বিএনপি সমর্থিত নীল প্যানেল) প্রার্থী ঘোষণা করে। তারা সভাপতি প্রার্থী হিসেবে সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল ও সম্পাদক প্রার্থী হিসেবে ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজলের নাম ঘোষণা করে।
এর পাশাপাশি সভাপতি ও সহ-সম্পাদক পদে জামায়াতের দুজন প্রার্থী হয়েছেন। সভাপতি পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়বেন আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবী ব্যারিস্টার তানিয়া আমীরও। একই পদে প্রার্থী হয়েছেন অ্যাডভোকেট ইউনুছ আলী আকন্দও।
প্রতিবারই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সাদা প্যানেল এবং বিএনপির নেতৃত্বাধীন নীল প্যানেল তাদের একক প্রার্থী ঘোষণা করে। এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পূর্ণ প্যানেল ঘোষণার পরও সভাপতি পদে একজন বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। অন্যদিকে, বিএনপি থেকে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম পূর্ণ প্যানেল ঘোষণা করার পরও সহ-সভাপতি ও সহ-সম্পাদক পদে জামায়াত সমর্থক দুজন প্রার্থী হয়েছেন। ফলে সাদা-নীল দুই প্যানেলই দুশ্চিন্তায় পড়েছে বিদ্রোহীদের নিয়ে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবীরা বলছেন, দলীয়ভাবে সবার সঙ্গে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে প্রার্থী দিয়ে প্যানেল ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে একজন মনোনয়ন চেয়েছিলেন, তাকে এবার মনোনয়ন দেওয়ার সুযোগ ছিল না। কিন্তু তিনি বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। তবে এটা নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচনে সাদা প্যানেলই জয়ী হবে।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের আহ্বায়ক ও সুপ্রিম কোর্টের সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, আমাদের দলের প্রার্থী হিসেবে যারা রয়েছেন, দলের পক্ষ থেকে সবাই বসে সিদ্ধান্ত নিয়েই তাদের মনোনয়ন দিয়েছি। আশা করি এতে কোনো সমস্যা হবে না।
সভাপতি পদে তানিয়া আমির বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট নজিবুল্লাহ হিরু বলেন, নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার স্বাধীনতা সবারই আছে, তিনিও (বিদ্রোহী প্রার্থী ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর) হয়েছেন। তিনি আমাদের কাছে মনোনয়ন চেয়েছিলেন। মনোনয়ন পাননি, তাই দাঁড়িয়েছেন। তাকে তো আর আমরা (প্রার্থী না হতে) জোর করবো না। পেশাজীবী হিসেবে স্বাধীনতা আছে নির্বাচন করার, করুক।’
সুপ্রিম কোর্ট বারে বিদ্রোহী হিসেবে ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর সভাপতি প্রার্থী হওয়ায় আওয়ামী লীগের ভোটে বিশেষ কোনো প্রভাব পড়বে না বলেও মনে করেন দলের আইন বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট নজিবুল্লাহ হিরু।
এদিকে নির্বাচনে জামায়াত সমর্থিত আইনজীবীদের কোনো পদে মনোনয়ন দেয়নি নীল প্যানেল। এ নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতপন্থি আইনজীবীদের মধ্যে চলছে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব। যদিও এর আগে সুপ্রিম কোর্ট বার নির্বাচনে তিনবার সহ-সভাপতি ও একবার সহ-সম্পাদক পদে জোটভুক্ত হয়ে নির্বাচন করে বিজয়ী হন জামায়াত সমর্থিত আইনজীবীরা। কিন্তু এবার একটি পদেও তাদের বিবেচনা করা হয়নি।
এবার কেন প্যানেলে জামায়াতপন্থি কারও নাম এলো না জানতে চাইলে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা বলছেন, জামায়াতের যোগ্য প্রার্থী নেই। যদিও বর্তমান কমিটিতে জামায়াতপন্থি আইনজীবী জালাল উদ্দিন সিনিয়র সহ-সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে আরও দুজন জামায়াতপন্থি আইনজীবী এই পদে নির্বাচিত হয়ে কাজ করেছেন। আর সহ-সম্পাদক পদে নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন জামায়াতপন্থি আইনজীবী সাইফুর রহমান।
বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা বলছেন, আমরা প্রতিবারের মতো তাদের (জামায়াত) সঙ্গে বসেছিলাম এবং প্রার্থীও চেয়েছিলাম। তবে তারা এমন একজনকে সহ-সভাপতি পদে প্রার্থী দিয়ে প্যানেল ঘোষণা করতে বলেছেন, যিনি আইন অঙ্গনে সুপরিচিত নন। প্রার্থী হিসেবে জোটের মনোনয়ন পাওয়ার মতো নন তিনি। তাই আমরা বলেছিলাম অন্য একজন যোগ্য প্রার্থী দিতে। কিন্তু তারা তা দিতে পারেননি, ব্যর্থ হয়েছেন। এখন তারা বলছেন আমরা প্রার্থী হিসেবে তাদের নেইনি। এটা সত্য নয়।
তবে জামায়াতপন্থি আইনজীবীরা বলছেন, আমরা প্রথমে তিনজনকে প্রার্থী করাতে চেয়েছিলাম। সহ-সভাপতি, সহ-সম্পাদক ও একজন সদস্য। কিন্তু তারা (বিএনপি) কাউকেই মনোনয়ন দেননি। তাই আমরা সহ-সভাপতি পদে একজন এবং সহ-সম্পাদক পদে একজনকে মনোনয়ন দিয়েছি। আমাদের প্রার্থী হিসেবেই তারা লড়বেন। বাকি পদগুলোর বিষয়ে আমরা তাদের (বিএনপি) সঙ্গে রয়েছি।
নীল প্যানেলে প্রার্থিতা না পাওয়ায় জামায়াতের দুজন প্রার্থী ঘোষণা ‘ঐক্যে ফাটল’ কি না, এমন প্রশ্নে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন।
প্রার্থিতা নিয়ে দ্বন্দ্বের বিষয়ে আইনজীবী সমিতির সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জামায়াত নেতা অ্যাডভোকেট মো. সাইফুর রহমান বলেন, আমরা মাত্র একটি প্রার্থী চেয়েছিলাম, সহ-সম্পাদক পদে। তাদের (বিএনপির) নিয়ম মেনেই আবেদন করেছিলাম। টাকা জমা দিয়ে প্রার্থী সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন। সহ-সম্পাদক হিসেবে আব্দুল করিমকে প্রার্থী চেয়েছিলাম। তাকে না দিয়ে এবং আমাদের সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনা না করে বারের নির্বাচনে তারা (বিএনপি পন্থিরা) জাতীয়তাবাদী আইনজীবী প্যানেল ঠিক করেন। এটা আর এখন বিএনপি-জামায়াত ঐক্য প্যানেল নেই। তাই আমরা দুজন প্রার্থী দিয়েছি। তাদের বিজয়ী করতে আমরা চেষ্টা করবো।
তিনি বলেন, আমরা যেহেতু একটি রাজনৈতিক দল, ফলে সুপ্রিম কোর্টের নির্বাচনে আমাদের প্রতিনিধিত্ব থাকা দরকার। যেহেতু আইনজীবী ফোরাম আমাদের সঙ্গে কোনো ঐক্যবদ্ধ প্যানেল করেনি, এমনকি আমাদের সম্মতিও নেয়নি। ফলে আমরা প্রার্থী দিয়েছি।
অ্যাডভোকেট মো. সাইফুর রহমান আরও বলেন, আমরা মূলত দুজনকে দলীয়ভাবে চেয়েছিলাম। বিএনপির কাছে দাবি ছিল যেন অন্তত একজনকে রাখা হয়, সেটা সহ-সম্পাদক পদে। যদিও আমরা এই নির্বাচনে প্রথম থেকেই তিনজন নিয়ে কাজ করেছি। আমাদের দাবি ছিল সহ-সভাপতি, সহ-সম্পাদক ও একজন সদস্য পদে প্রার্থী দেওয়ার। এমনকি সবশেষে ফোরামকে বলেছি আমাদের শুধু সহ-সম্পাদক পদে প্রার্থিতা দিলেই হবে। কিন্তু তারা এটা দিতেও রাজি না হয়ে নিজেরা একটি প্যানেল ঘোষণা করে। ফলে একদম শেষ সময়ে এসে আমরা প্রার্থী দিয়েছি।
বিএনপি ও জামায়াতের ঐক্যের ফাটল নিয়ে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সুপ্রিম কোর্ট ইউনিটের সভাপতি অ্যাডভোকেট আব্দুল জব্বার (এজে) ভূঁইয়া বলেন, আমাদের দলের ভেতরে কোনো কোন্দল নেই। গত দুই-তিন বছরে সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচনে জামায়াতের পক্ষ থেকে সহ-সভাপতি পদ চাইতো এবং তাদের দেওয়া হতো। কিন্তু এ বছর আমাদের প্রার্থী বেশি। তাই আমরা সংকুলান করতে পারছি না।
তিনি বলেন, সহ-সভাপতি পদের প্রার্থী হিসেবে তাদের যোগ্যতা না থাকলেও এতদিন তারা আমাদের ভোটে পাস করে যেতো। সহ-সভাপতির দুটো পোস্টের মধ্যে একটা তাদের (জামায়াত) দিলেও আমাদের একটা থাকতো। তবে আমরা লক্ষ্য করলাম যে, ভোটে তাদের প্রার্থী পাস করিয়ে অপর ভোটটি আওয়ামী লীগকে দিতো। এটা ধরা পড়ার পর আমরা বিষয়টি তাদের বললাম। তখন তারা বললো এটা আমাদের নির্বাচনী কৌশল। দেখা গেল যে পুরো প্যানেলের ভোট আমাদের, কিন্তু একটা ভোট আওয়ামী লীগের। তারপর থেকে আমাদের ফোরামের নেতারা বললেন যে, এদের আর প্রার্থিতা দেওয়া যাবে না। বড়জোর একটা সদস্য পদ দেওয়া যেতে পারে। এর ওপরের কোনো পদে দেওয়া যাবে না। এই সিদ্ধান্তে আমরা সবাই একমত ছিলাম।
আব্দুল জব্বার ভূঁইয়া আরও বলেন, তারা (জামায়াত) এবার প্যানেলের সহ-সভাপতি হিসেবে আব্দুল করিমকে মনোনয়ন দিতে চাইলো। অথচ তিনি সদস্য হওয়ারও যোগ্যতা রাখেন না। তিনি এতটাই অপরিচিত যে তাকে সদস্য পদে মনোনয়ন দিলেও পাস করার সম্ভাবনা কম।
তিনি বলেন, সবশেষ প্যানেল চূড়ান্ত হওয়ার পরে তারা আমাদের নেতাদের সঙ্গে আবারও দেন-দরবার শুরু করলো। এ সময় তারা একটি সদস্য পদ চাইলেও দেওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ আমাদের প্যানেল তখন চূড়ান্ত হয়ে গেছে। গত বছর আমাদের চারজন সদস্য প্রার্থী খুবই কম ভোটের ব্যবধানে ফেল করেন। তাদের নিয়ে আর বাকি থাকে তিনজন। তাদেরও চূড়ান্ত করে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। তাই আমাদের নেতারা বললেন যে এই বছর আর হবে না। আপনারা কাজ করেন, দেখা যাক। আগামী বছর বিবেচনা করা হবে।
আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াত নিয়ে যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে, সেটা এই নির্বাচন থেকেই শুরু হলো কি না- এই প্রশ্নের জবাবে বিএনপিপন্থি এই আইনজীবী কোনো মন্তব্য করেননি।
তবে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সুপ্রিম কোর্ট ইউনিটের সম্পাদক অ্যাডভোকেট গাজী মো. কামরুল ইসলাম সজল বলেন, জামায়াতের আইনজীবীর দেওয়া তথ্য ঠিক নয়। বারবার বলার পরও তারা প্রার্থী দেননি। বলা হয়েছিল সহ-সভাপতি দেন, অথবা সদস্য প্রার্থী দেন। মনোনয়ন প্রত্যাহারের আগে তাদের বহুবার বলা হয়েছে, একজন সহ-সভাপতি, সহ-সম্পাদক বা সদস্য দেন। আমদের প্যানেলে সহ-সম্পাদক পদে প্রার্থী সংকট। তারা অ্যাডভোকেট গিয়াস উদ্দিন মিঠুকে দিতে চেয়েছিল। আমরা বলেছিলাম তিনি ভালো প্রার্থী, তাকে দেন। কিন্তু তিনি ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে রাজি হননি। তিনি নির্বাচন করবেন না। মনে হচ্ছে, তারা আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে তারা আমাদের সঙ্গে নির্বাচন করবে না। না হলে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেবে কেন!