বাংলাদেশে দুর্গাপূজার সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজামণ্ডপ ও মন্দিরে হামলা ও সহিংসতার ঘটনা নিয়ে দেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপি পরস্পরকে দোষারোপ করছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা বলছেন দোষারোপ বাদ দিয়ে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে উদাহরণ তৈরি করা উচিত।বাংলাদেশে সাধারণত পূজার সময় দেশে একটি উৎসবমুখর পরিবেশ থাকলেও এবারে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন।
কুমিল্লার একটি মণ্ডপে কোরআন পাওয়ার জের ধরে গত ১৩ই অক্টোবর থেকে পরবর্তী কয়েকদিন দেশজুড়ে অসংখ্য পূজামণ্ডপ ও মন্দিরে হামলা হয়েছে।পুলিশের হিসেবে সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছে অন্তত সাতজন। হামলা ও অগ্নিসংযোগ হয়েছে হিন্দুদের বাড়িঘর ও দোকানপাটেও।
কুমিল্লায় কোরআন পাওয়ার পর সেখানে যখন একের পর এক মন্দিরে, মণ্ডপে হামলার চেষ্টা হচ্ছিলো তখনই সেখানে পূজা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্মল পাল বিবিসিকে বলেছিলেন যে ঘটনার পরপরই একদল মাদ্রাসা শিক্ষার্থী মিছিল সমাবেশ শুরু করে, কিন্তু পরে সব দলের কর্মী সমর্থকদেরই তাতে অংশ নিতে দেখা গেছে। তার বক্তব্য ছিলো, "কোরআন শরীফ একটা হনুমানের পায়ের নিচে রেখেছে। যে রাখছে সেই চিৎকার করেছে যে দেখেন হিন্দুরা কি করছে, কোরআন পায়ের নিচে রাখছে। এটা বলেই যা ঘটানোর ঘটিয়েছে। যখন ঘটনা ঘটে তখন সব লোক- কে আওয়ামী লীগ, কে বিএনপি, কে কমিউনিস্ট পার্টি, কে ন্যাপ, কে জাসদ, কে বাসদ- কিছু নেই—সব এখন সমান"।পরে আরও কয়েকটি জায়গায় তৌহিদী জনতার ব্যানারে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ রাজনৈতিক নেতাদের অংশ নেয়ার খবরও এসেছে গণমাধ্যমে।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পরস্পরকে দোষারোপ
কিন্তু কুমিল্লাসহ বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতার মধ্যেই এসব ঘটনার পর পরস্পরকে দায়ী করতে শুরু করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ১৮ই অক্টোবর ঢাকায় এক কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে বলেন সরকার তার ব্যর্থতা থেকে মানুষের দৃষ্টি সরাতেই এমন ঘটনা ঘটিয়েছে।
"এহেন অমানবিক কাজ নেই যা সরকার করছে না। তার সর্বশেষ পরিস্থিতি কুমিল্লার পূজামণ্ডপে আপনারা দেখেছেন। কারণ করোনায় ব্যর্থতা, মানুষকে সুচিকিৎসা দিতে না পারা, খাদ্য নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়া, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি- সেগুলো মোকাবেলা করতে না পারার কারণেই কৃত্রিমভাবে কুমিল্লার ঘটনা ঘটানো হয়েছে।"
তবে এর মধ্যেই কোরআন রাখার ঘটনার জন্য ইকবাল হোসেন নামে একজন শনাক্ত করে তাকে আটক করেছে পুলিশ। কুমিল্লার পর কারা ঘটনাটিকে ছড়িয়েছে বা আর কারও ইন্ধন ছিলো কি-না তা নিয়ে এখনো তদন্ত চালাচ্ছে পুলিশ। কিন্তু এরই মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারাও ঘটনার জন্য বিএনপিকে দোষারোপ করতে শুরু করে। দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলছেন ঘটনার পর কারা প্রচার করেছে বা অন্যদের সংঘটিত করার চেষ্টা করেছে তা দেখলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে যে পেছনে থেকে বিএনপিই পুরো ঘটনার পৃষ্ঠপোষকতা করেছে।
তিনি বলেন, "আমাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য ছিলো নাশকতা সৃষ্টির। সরকার, প্রশাসন ও আওয়ামী লীগ সচেতন ছিলো বলে সব জায়গায় তারা করতে পারেনি। কিছু কিছু জায়গায় বা পকেটে আমাদের কিছু উদাসীনতার কারণে তারা এ অপকর্মটি করতে পেরেছে। এর পেছনে মূল চক্রান্তকারী ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি ও তাদের পৃষ্ঠপোষক বিএনপি।"
ঢালাও রাজনীতিকরণের অভিযোগ হিন্দু নেতাদের
কিন্তু এবার দুর্গাপূজার সময় এমন নজিরবিহীন সহিংসতা নিয়ে এমন রাজনৈতিক বিবাদে বিতণ্ডায় রীতিমত বিরক্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ।
পূজা উদযাপন কমিটির কেন্দ্রীয় সম্পাদক নির্মল চ্যাটার্জি বলছেন ঢালাও রাজনীতিকরণ করে ঘটনাগুলোর বিচার প্রলম্বিত করার চেষ্টা দেশের জন্যই ক্ষতিকর হবে।
"আমরা কোন দোষারোপের রাজনীতি চাইনা। আমরা চাই সরকার প্রকৃত যারা দোষী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিক। রামু থেকে আজ পর্যন্ত যা হয়েছে -একটিরও বিচার হয়নি। এ বিচারহীনতা আমরা চাই না। তাতে মানুষের হৃদয় ভেঙ্গে যায় ও দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অবশ্যই অপশক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে সে যে ধর্ম বা বর্ণেরই হোক না কেন। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।" রামুতে বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত তাদের ওপর সংঘটিত হামলার কোন ঘটনার জন্যই অপরাধীরা শাস্তি পায়নি বলে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ এখন ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।
বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের সভাপতি ড. ময়না তালুকদার বলছেন শাস্তি বা বিচার তো হয়ই না, বরং হিন্দুদের উপর কিছু ঘটলেই তা নিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম করা একটি পুরনো রীতিতে পরিণত হয়েছে।
"জন্মলগ্ন থেকেই তো শুনছি। এর দোষ ওর ঘাড়ে, ওর দোষ এর ঘাড়ে চাপায়। এ কারণেই তো প্রকৃত দোষীদের শাস্তি হচ্ছে না। প্রকৃত দোষীদের বিচারের আওতায় আনছে না। বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা। এ কারণেই দোষীরা শাস্তি পাচ্ছে না।"
তিনি বলেন এ সংস্কৃতির অবসান করে এবার অন্তত দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির উদাহরণ তৈরি করা উচিত সরকারের ।অন্যদেরও উচিত এমন ভয়াবহ অপরাধকে নিয়ে রাজনীতি না করে অপরাধ হিসেবেই বিবেচনা করে এর বিচার নিশ্চিত করতে চাপ তৈরি করা।