কৃষকের বুক ভরা আশা। আর কয়েক দিন পর ফসল উঠবে ঘরে, সংসারে আসবে সচ্ছলতা। চোখে ছিল সোনালি স্বপ্নের ঝিলিক। কিন্তু তিস্তার আকস্মিক বন্যায় কৃষকের কপালে এখন চিন্তার ভাঁজ।উজানে ভারত গজলডোবা ব্যারাজের সবকয়টি গেট খুলে দেওয়ায় ভাটি অঞ্চলে তিস্তা অববাহিকায় পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তিস্তাবেষ্টিত লালমনিরহাট, নীলফামারী ও রংপুরের গঙ্গাচড়ার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে আকস্মিক বন্যা দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার নিম্নাঞ্চলের ফসলী জমিতে পানি ঢুকে পড়েছে। মধ্যরাতের দিকে পানি বৃদ্ধি পেয়ে বন্যার আশংকা করছে স্থানীয় প্রশাসন।
বুধবার (২০ অক্টোবর) বিকালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিস্তার পানি দোয়ানি পয়েন্টে সকালের দিকে বিপৎসীমার ৬০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। দুপুর ১২টার দিকে ৭০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। বিকাল ৩টার দিকে তিন সেন্টিমিটার কমে ৬৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। একই সময়ে ভাটিতে কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
তিস্তা ব্যারাজের সড়কের 'ফ্লাট বাইপাস' ভেঙে গেছে। ফলে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। বুধবার সকাল ৬টা থেকে নীলফামারীর ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। যা সকাল ৯টায় আরও ১০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৬০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
ফলে ডিমলা উপজেলার পূর্ব ছাতনাই, খগাখড়িবাড়ি, গয়াবাড়ি, টেপাখড়িবাড়ি, খালিশাচাঁপানী, ঝুনাগাছ চাঁপানী এবং জলঢাকা উপজেলার গোলমুন্ডা, ডাউয়াবাড়ি, শৌলমারী ও কৈমারীসহ ১০টি ইউনিয়নের ২২টি গ্রাম বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন প্রায় ১০ হাজার পরিবারের ৪০ হাজার মানুষ। চরাঞ্চলের এসব বাড়িঘরে ৫ থেকে ৭ ফুট পানি উঠেছে। পানির নিচে তলিয়ে গেছে এসব এলাকার ফসলি জমিসহ রাস্তাঘাট।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, দেশের উজানে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সিকিম, দার্জিলিং, জলপাইগুড়িতে ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। এতে তিস্তা নদীর পানি সমতল বাংলাদেশে মঙ্গলবার (১৯ অক্টোবর) মধ্যরাত থেকে বৃদ্ধি পাওয়া শুরু করেছে। বর্তমানে ডালিয়া পয়েন্টে ৫৩.২০ মিটার লেভেলে বিপৎসীমার ৬০ সেমি ওপর অবস্থান করছে। বিগত ১২ ঘণ্টায় তিস্তা নদীর পানি সমতল ডালিয়া পয়েন্টে প্রায় ২০০ সেমি বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পানি বৃদ্ধি বুধবার (২০ অক্টোবর) সন্ধ্যা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। আরও ১০ থেকে ১৫ সেমি বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বৃহস্পতিবার (২১ অক্টোবর) ভোর নাগাদ এই পানি বিপৎসীমার নিচে চলে আসতে পারে।
এদিকে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় ফ্লাট বাইপাস ভেঙে যাওয়ায় বড়খাতার বাইপাস সড়কের তালেব মোড় এলাকার সড়কটিতে পানি ছুঁইছুঁই করছে। এ ভাঙনের ফলে এরই মধ্যে ওই এলাকার ২০০টি ঘরবাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। পানির তোড়ে ভেঙে গেছে নীলফামারীর ডিমলার পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নের কালিগঞ্জ নামক স্থানের ৪০০ মিটার গ্রোয়েন বাঁধ। এতে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে ৪০০ পরিবারের ঘরবাড়ি।
আকস্মিক বন্যার পানির তোড়ে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার আলমবিদিতর, লক্ষ্মীটারি, কোলকোন্দ, নোহালী ও গজঘণ্টার নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকে পড়েছে। দেখা দিয়েছে নদীভাঙন। অনেক পরিবার এখন পানিবন্দি হয়ে আছে। নদীঘেঁষা চরাঞ্চলসহ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় অনেকেই উঁচু জায়গায় আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করছে। লক্ষ্মীটারি ইউনিয়নের চরইশরকুল, ইছলি, পূর্ব ইছলি, পশ্চিম ইছলি ও শংকর, বাগেরহাট, কেল্লারহাটসহ বেশকিছু নিচু এলাকায় কৃষিজমি পানিতে তলিয়ে আছে।
পানি বাড়ছে তিস্তার কাউনিয়া পয়েন্টে।
লক্ষ্মীটারি ইউনিয়নের চরইশরকুল গ্রামের কৃষক আব্দুল হালিম বলেন, ‘শীতের শুরুতে বাজারে আগাম আলুর প্রচুর চাহিদা থাকে। দামও ভাল পাওয়া যায়। কিন্তু তিস্তার পানি বাড়তে থাকায় এবারও ক্ষেত নষ্ট হয়ে যাবে।
উপজেলার পূর্ব ইছলি গ্রামের কৃষক আব্দুর রহমান বলেন, আর কয়েক দিন পর ধান কাটা যেত। ফসল ঘরে উঠত। কিন্তু এ বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হবে।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ্ আল হাদি বলেন, তিস্তা প্রায় শুকিয়ে গিয়েছিল। জেগে উঠেছিল চর। সেখানে কৃষকরা ফসল ফলেছিল। কিন্তু আকস্মিক বন্যায় সব তলিয়ে গেছে।
পাউবোর ডালিয়া বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আসফাউদ্দৌলা প্রিন্স বলেন, উজানে ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের কারণে তিস্তার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। পানির চাপে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে দিয়ে নদীর পানিপ্রবাহ অব্যাহত রাখা হয়েছে। তবে আগামীকালের মধ্যে পানি বিপৎসীমার নিচে নেমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।