বাংলাদেশে বিভিন্ন জায়গায় হিন্দুদের ওপর হামলা এবং সহিংসতার ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল কুমিল্লায় একটি পূজামণ্ডপে কোরআন পাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। কর্তৃপক্ষ বলেছে, সেই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে কয়েকজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে।কিন্তু ঘটনাটি আসলে কিভাবে ঘটেছিল -তা নিয়ে কথা হয় স্থানীয় লোকজনের সাথে। পূজামণ্ডপটি ছিল কুমিল্লা শহরেই নানুয়াদীঘির পাড়ে, যে দীঘির চারপাশে অনেক হিন্দু পরিবারের বসবাস। তারা ২০ বছরের বেশি সময় ধরে অস্থায়ী মণ্ডপ তৈরি করে সেখানে দূর্গাপূজা করে আসছেন।
পূজার আয়োজকদের মধ্যে অন্যতম একজন অচিন্ত্য দাশ জানিয়েছেন, সপ্তমী শেষে রাত আড়াইটা পর্যন্ত তাদের পূজা মণ্ডপে লোকজন ছিল। এরপর লোকজন চলে গেলে আয়োজকরা অস্থায়ী মঞ্চের মূল পূজামণ্ডপ পর্দা দিয়ে ঘিরে রেখেছিলেন।
সেই মঞ্চের বাইরে অল্প দূরত্বে গণেশের মূর্তি ছিল, সেটি উন্মুক্ত ছিল। সেখানেই কেউ রেখে গিয়েছিল কোরআন ।
তিনি অবশ্য বলেছেন, বেসরকারি একটি কোম্পানি থেকে ভাড়া করা একজন নিরাপত্তা কর্মী ভোররাত পর্যন্ত পাহারায় ছিলেন। সেখানে যখন কোরআন রাখা হয়েছে, সেই নিরাপত্তা কর্মী সেসময় সেখানে ছিলেন না।
ট্রিপল নাইনে ফোন ও ফেসবুকে লাইভ
তবে ভোরেই একজন তরুণ ট্রিপল নাইনে (৯৯৯) ফোন করে জানান যে, তিনি পূজামণ্ডপে কোরআন রাখা আছে দেখতে পাচ্ছেন।
আরেকজন তরুণ সেখান থেকে ফেসবুকে লাইভ করেছেন ঘটনাটি নিয়ে।
কিন্তু কোরআন রাখার প্রত্যক্ষদর্শী কেউ আছেন কিনা, সেটা এখনও কেউ বলতে পারছে না।
তবে একজন তরুণের ট্রিপল নাইনে ফোন করা এবং আরেকজনের ফেসবুক লাইভ করা- এই দু'টি ঘটনার মাধ্যমে বিষয়টা জানাজানি হয়।
পরে অবশ্য পুলিশ ফয়েজ এবং ইকরাম নামের ওই দু'জনকে গ্রেপ্তার করে।
বিবিসি বাংলাকে অচিন্ত্য দাশ বলেছেন, খবর পেয়ে কুমিল্লার কোতোয়ালি থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সকাল সাড়ে সাতটার দিকে ঘটনাস্থলে আসেন। এরপর ওই পুলিশ কর্মকর্তা পূজামণ্ডপ থেকে কোরআন সরিয়ে নিয়ে যান। মি. দাশ জানিয়েছেন, সে সময়ই একজন তরুণের ফেসবুক লাইভে পুলিশ কর্মকর্তার কোরআন সরিয়ে নেয়ার দৃশ্য দেখা গেছে।
এই মণ্ডপের পাশেই বসবাসকারী একটি হিন্দু পরিবারের একজন সদস্য নাম পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, তাদের পূজামণ্ডপে কোরআন রাখার খবরটি তিনি পেয়েছেন ভোরে। এর অল্প সময়ের মধ্যেই গোটা এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে এবং হামলা হয় তাদের মণ্ডপে ।
টেলিফোনে ঘটনার খবর পেয়ে সকাল সাড়ে সাতটার দিকে সেখানে গিয়েছিলেন পূজার আয়োজন কমিটির আরেকজন নেতা। তিনি পরের ঘটনাগুলো প্রত্যক্ষ করেছেন।
তিনিও নাম পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, কোরআন পাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে অল্প সময়েই সেখানে অনেক মানুষ জড়ো হয়। তারা পূজা বন্ধ করে দেয়ার দাবি তোলে এবং চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।
অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ
এক পর্যায়ে জড়ো হওয়া লোকজন পূজামণ্ডপে হামলা চালায় এবং অস্থায়ী মঞ্চ আর প্রতিমা ভাঙচুর করে।
এরপর কুমিল্লারই বিভিন্ন পূজামণ্ডপে এবং হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা হয়।
এই পূজার আয়োজকদের অনেকে অভিযোগ করেছেন, নানুয়াদীঘির একপাড়ে ছিল পূজামণ্ডপ এবং অপর পাড়েই কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়রের বাসভবন। কিন্তু ভোরেই তাকে ঘটনা জানানো হলেও তিনি অনেক দেরিতে ঘটনাস্থলে আসেন। তার আগেই সেখানে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল।
তবে মেয়র মনিরুল হক তার বিরুদ্ধে ওঠা গাফিলতির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
তিনি বলেছেন, খবর পাওয়ার পর সকাল নয়টায় ঘটনাস্থলে গিয়ে তিনি পুলিশ প্রশাসন এবং সেখানে উপস্থিত হিন্দু নেতাদের সাথে আলোচনা করে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করেছেন।
তিনি বরং পাল্টা অভিযোগ করেছেন যে কোতোয়ালি থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা যখন কোরআন সরিয়ে নেন, তখন সেখানে যে তরুণ ফেসবুক লাইভ করছিলেন, তখন তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। পরে সেই তরুণকে গ্রেপ্তার করা হয় সন্ধ্যায়।এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মেয়র।
সেদিনের ঘটনাবলী এবং বিভিন্ন অভিযোগের ব্যাপারে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনোয়ারুল আজিমের সঙ্গে আমরা কথা বলতে চেয়েছি, তবে কোন বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
কোরআন রাখার ঘটনাটি পরিকল্পিত?
কুমিল্লায় গত ১৩ই অক্টোবরের ঘটনাবলী সম্পর্কে কোন বক্তব্য দিতে চাননি সেখানকার পুলিশ প্রশাসনের কেউই।
তবে কুমিল্লা সদরের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, পুলিশের কোন গাফিলতি ছিল না, বরং পুলিশ ঘটনার ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছে।
ঘটনার পেছনে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কোন দ্বন্দ্বের বিষয় আছে কিনা-এমন প্রশ্ন স্থানীয়দের অনেকেই তুলেছেন।
সংসদ সদস্য মি. বাহার বলেছেন, কোরআন রাখার ঘটনাটি পরিকল্পিত বলেই তারা ধারণা করছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহে কয়েকজনকে পুলিশ চিহ্নিত করেছে।
পূজামণ্ডপে কোন সিসিটিভি ছিল না। তবে আশেপাশের বাড়িগুলোর কিছু সিসিটিভি ফুটেজ পুলিশ সংগ্রহ করেছে।
পাঁচটি মামলায় এ পর্যন্ত ৪০জনের বেশি লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অপরাধীদের কঠোর শাস্তি এবং সেই সাথে হিন্দু সম্প্রদায়কে নিরাপত্তা দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন।