ভারতীয় রাজনীতিতে সবচেয়ে বিভেদ সৃষ্টিকারী ব্যক্তিদের একজন ছিলেন ভিনায়ক দামোদর সাভারকার। কট্টর দক্ষিণপন্থী এই রাজনীতিকের মৃত্যুর পাঁচ দশক পর ভারতীয় রাজনীতিতে এখন তাকে নিয়ে নতুন করে শুরু হয়েছে এক বিতর্ক। ব্রিটিশ শাসনামলে বন্দি থাকা অবস্থায় কে তার হয়ে বারবার ব্রিটিশদের কাছে ক্ষমা চেয়েছিল- তিনি নিজে- নাকি মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী? কিন্তু কেন এই বিতর্ক? আর কেনই বা এত বছর পর আবার আলোচনায় এলেন মি. সাভারকার।সাভারকারের সমালোচকরা অভিযোগ করে থাকেন, ১৯৪৮ সালে মি. গান্ধীর হত্যার পেছনে তার হাত ছিল। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার ইতিবাচক ভূমিকা ছিল কিনা সে প্রশ্নও তারা তুলেছেন। এমনকি একটা "হিন্দু রাষ্ট্রের" জন্য তিনি সালিশী করেছিলেন বলেও তাদের চোখে তিনি নিন্দিত।
অন্যদিকে, সাভারকারের সমর্থকরা বলে থাকেন, এই নেতা পরবর্তীকালে হিন্দু মহাসভা দলের নেতৃত্ব দেন এবং "হিন্দুত্ব"বাদের জন্ম তার হাত ধরেই। তাদের মূল্যায়নে তিনি ছিলেন কট্টর জাতীয়তাবাদী এবং অপ্রতিরোধ্য দেশপ্রেমী।
সাভারকারকে নিয়ে এখন কেন বিতর্ক?
এ সপ্তাহে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং এই বিতর্ককে উস্কে দিয়ে বলেছেন মি. সাভারকারকে নিয়ে "বহু মিথ্যা প্রচারণা" রয়েছে যে তিনি আন্দামান জেলে থাকার সময় "ব্রিটিশ সরকারের কাছে একাধিকবার ক্ষমা ভিক্ষা করে আবেদন জানিয়েছিলেন।"
মি. সিং জোরের সঙ্গে বলেন মি. সাভারকার "তার মুক্তির জন্য কখনই কোন আবেদন করেননি", বরং তিনি বলেন, তাকে ক্ষমা চাইতে বলেছিলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী।
মি. সাভারকারের সমালোচকরা মি. সিংএর এই মন্তব্যে প্রতিবাদের মুখর হয়েছেন। তারা বলছেন, মি. গান্ধী সবসময়েই শান্তিপ্রিয় এবং বিপ্লবের বিরুদ্ধবাদী ছিলেন। তিনি কখনই মি. সাভারকারকে এধরনের পরামর্শ দিতে পারেন না এবং তার মুক্তিকে তিনি সমর্থন করেননি।
বিরোধী দলীয় একজন নেতা বলেছেন মি. রাজনাথ সিং "ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা করছেন"। মি. সাভারকারের জীবনীকাররা মনে করেন সত্য ঘটনা অতটা সোজা-সাপ্টা নয়।
যেমন, মি. সাভারকার আন্দামান দ্বীপের কুখ্যাত সেলুলার জেল থেকে মুক্তির জন্য ১৯১১ থেকে ১৯২০-এর মধ্যে অন্তত সাতবার আবেদন জানিয়েছিলেন। ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে তার রাজ্যে বিদ্রোহ করার দায়ে তিনি ও তার ভাই গণেশকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল এবং আন্দামানের জেলে তারা দুই ভাই দশ বছর কাটান ।
ভারতে রাজনৈতিক বন্দিদের ক্ষমা প্রদর্শনের জন্য ব্রিটিশ রাজের ঘোষণার পর তিনি এই আবেদন জানান বলে জানা যায়। তবে, ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের একজন মনে করেন যে, মি. সাভারকার ছিলেন "ভারতের সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যক্তিদের একজন' এবং তার আবেদন তারা নাকচ করে দেন।
তার জীবনীকাররা বলছেন, মি. সাভারকারের মুক্তির জন্য একের পর এক আবেদন জানানোর একটা কারণ হয়ত ছিল যে আন্দামানের কারাগারে দুঃসহ পরিস্থিতির ফলে তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটছিল। তিনি ১৯২০ সালে যে আবেদন করেছিলেন, তাতে তিনি বলেছিলেন "সংবিধান মেনে রাজনৈতিক কার্যকলাপ চালাতে তিনি রাজি আছেন এবং দীর্ঘ সময়ের জন্য রাজনৈতিক কোন কার্যক্রমে তিনি জড়িত থাকবেন না", বলছেন ঐতিহাসিক এবং মি.সাভারকারের ওপর দুই খণ্ডের জীবনীগ্রন্থের লেখক ভিক্রম সামপাথ।
সমালোচকরা মি. সাভারকারের এই আবেদন নিয়ে ঠাট্ট করেন এই অভিযোগ তুলে যে, জেল থেকে ছাড়া পেতে ব্রিটিশ সরকারের কাছে তিনি এই আবেদন করেছিলেন। তারা আরও বলেন যে এই নেতা নিজে যে আবেদনগুলো লিখেছিলেন তা তিনি গোপন রেখেছিলেন।
তবে, মি. সাভারকারের কিছু সমর্থক এই তথ্যের ঘোর বিরোধী। তারা বলছেন, তিনি কখনই এমন কোন আবেদনপত্র লেখেননি, আর লিখে থাকলেও তিনি কখনও ব্রিটিশদের কাছে ক্ষমা চাননি।
"দুটি দাবিই অসত্য। মি. সাভারকার ক্ষমা প্রার্থনা করে আবেদন করেছিলেন, এবং সেকথা কখনও তিনি অস্বীকার করেননি," বলছেন তার সাম্প্রতিক আরেকজন জীবনীকার বৈভব পুরানদারে।
কেমন ছিল গান্ধী ও সাভারকারের সম্পর্ক?
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী আর ভিনায়ক সাভারকারের মধ্যে ছিল প্রচণ্ড বিরোধ। ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ বলছেন, মি.সাভারকারের সাথে মি. গান্ধীর বৈরিতা প্রথম সামনে আসে ১৯০৯ সালে যখন "তিনি প্রকাশ্যে গান্ধীকে অপমান করেছিলেন"।
"গান্ধীর প্রতি তার ঘৃণা ছিলে একান্ত ব্যক্তিগত পর্যায়ে," বলছেন ড. গুহ।
যখন মি. গান্ধীর স্ত্রী কস্তুরবা গান্ধী মারা যান, তখন তার স্মৃতি রক্ষার্থে যে তহবিল গঠন করা হয়, মি. সাভারকার সেখানে কোন অর্থ দিতে অস্বীকৃতি জানান। মি সাভারকারের যুক্তি ছিল "ব্রিটিশ শাসকদের দেশছাড়া করতে সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নেয়া যেসব পুরুষ ও নারীকে ব্রিটিশরা ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল বা গুলি করেছিল, তাদের জন্য গান্ধী কখনও এক ফোঁটা চোখের জল ফেলেননি," বলেছেন ড. গুহ। অথচ, ১৯২০ সালের জানুয়ারি মাসে, ভিনায়ক সাভারকারের সবচেয়ে ছোট ভাই নারায়ণ রাও "অকল্পনীয় একটা কাজ করেছিলেন"। যে মি. গান্ধীর সাথে আদর্শগতভাবে ঘোর বিরোধ তার ভাইয়ের, সেই গান্ধীকে তিনি একটা চিঠি লিখেছিলেন, বলছেন ড. সামপাথ।
"তার লেখা ছয়টি চিঠির প্রথমটিতে তিনি ব্রিটিশ রাজার ঘোষণার পর কীভাবে তার বড় ভাইয়ের মুক্তি আদায় করা যাবে সে ব্যাপারে মি. গান্ধীর সাহায্য ও পরামর্শ চেয়েছিলেন।"
এক সপ্তাহ পর মি. গান্ধী সেই চিঠির একটা মামুলি উত্তর পাঠিয়েছিলেন।
তিনি লিখেছিলেন: "তোমাকে পরামর্শ দেয়া কঠিন। তবে আমার প্রস্তাব হল - একটা সংক্ষিপ্ত পিটিশন লিখতে পার ঘটনার সত্য তথ্য দিয়ে। তাদের আশ্বস্ত করে এটা বলতে পার যে তোমার ভাই যে অপরাধ করেছে সেটা নিতান্তই রাজনৈতিক।"
তবে কয়েক মাস পর মি. গান্ধী ইয়াং ইন্ডিয়া নামে এক সাপ্তাহিক পত্রিকায় "তাদের মুক্তির জন্য একটা কেস খাড়া করেছিলেন।" তিনি তাতে লিখেছিলেন, সাভারকার ভাইরা বলেছে "তারা কোন বিপ্লবী মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না।"
কী ধরনের বিভেদ সৃষ্টিকারী ব্যক্তি মি. সাভারকার?
সাম্প্রতিক এই বিতর্ক নিছকই যুক্তিহীন, মনে করছেন ড. সামপাথ। কিন্তু ভারতে ভিনায়ক দামোদর সাভারকার যে এখনও বিভাজন সৃষ্টিকারী একজন ব্যক্তি এবং রাজনৈতিক মেরুকরণের কেন্দ্রে, তাকে নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনের সাম্প্রতিক এই হৈচৈ সেটাই প্রমাণ করেছে।
তার সমর্থকদের কাছে তিনি বীর সাভারকার, তার সমালোচকদের কাছে তিনি নিন্দিত।
মি. সাভারকার পরস্পরবিরোধী চরিত্রের একজন মানুষ। একদিকে তিনি ছিলেন হিন্দু জাতীয়তাবাদের পক্ষে সোচ্চার এক রাজনৈতিক প্রবক্তা। অন্যদিকে আবার তিনি যুক্তিবাদী। হিন্দু রক্ষণশীলতা, জাতপাত এবং হিন্দুদের আরাধ্য হিসাবে গরুকে পূজার তিনি ছিলেন বিরুদ্ধে।
কিন্তু মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে হত্যার ষড়যন্ত্রে তাকে অভিযুক্ত করার পর থেকে মি. সাভারকার রাজনৈতিকভাবে "একঘরে" হয়ে যান।
জীবনের প্রায় এক তৃতীয়াংশ তিনি একরকম বন্দিদশায় কাটিয়েছেন- হয় জেলখানায় নয় অবরুদ্ধ অবস্থায়। ১৯৬৬ সালে ৮৩ বছর বয়সে তিনি মারা যান। "তার জীবন পরস্পর-বিরোধিতার ঠাসা এবং ঐতিহাসিকদের কাছে তিনি রহস্যময় ও দুর্বোধ্য এক ব্যক্তি," বলছেন ড. সামপাথ। তবে ভারতে বিজেপির শাসনামলে মি. সাভারকারের বিশাল পুনরুত্থান ঘটেছে। বিজেপির মতাদর্শের মূল খুঁটি বা উৎস আরএসএস, মি. সাভারকারের ধ্যান-ধারণার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত।
বিজেপির মতাদর্শের মূল ভিত হল হিন্দুত্ব।
সেই হিন্দুত্বের জনক ও পুরোধা হিসাবে মি. সাভারকার বিজেপির চোখে বীর ও আরাধ্য এবং অনুসরণীয় একজন ব্যক্তি।
"মি. সাভারকার সবসময়েই উগ্র চেতনার জন্ম দিয়েছেন। রাজনৈতিক বিপ্লবী থেকে রাজনৈতিকভাবে অস্পৃশ্য -জীবনের প্রতিটি স্তরে তিনি বিতর্কিত হয়ে উঠেছেন," বলেছেন ঐতিহাসিক মি. পুরানদারে।
তিনি বলছেন, বহুল বিতর্কিত এই নেতা এখন বিজেপির শাসনামলে নতুন করে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠছেন। হিন্দুত্বের জনক হিসাবে তার লেগাসি এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে একটা নতুন মাত্রা পাচ্ছে।