দেশের মধ্যশিক্ষিত, বেকার ও নিরীহ যুবক এবং সরল শ্রেণির মানুষদের টার্গেট করে মোটিভেশনাল বক্তব্য দিয়ে কোম্পানিতে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ‘সুইসড্রাম’ নামে এক মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) প্রতিষ্ঠান।সুইসড্রাম কোম্পানিতে বিনিয়োগের জন্য প্রথমে সুইসড্রাম অ্যাপ- এ অ্যাকাউন্ট খুলে সদস্য হতে হয়।এরপর সদস্য সংগ্রহ করে আরও বিনিযোগের কথা বলা হয়। এরপর এক স্থান থেকে অন্যত্র কার্যালয় স্থানান্তর করতেন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক কাজী আল-আমিন।
মঙ্গলবার (২১ সেপ্টেম্বর) রাত সাড়ে ৮টা থেকে বুধবার (২২ সেপ্টেম্বর) সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত রাজধানীর পল্টন এলাকায় অভিযান চালিয়ে কাজী আল-আমিনসহ ১৭ জন প্রতারকদের গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতার বাকিরা হলেন- মো. সালাউদ্দিন (৪৬), শেখ মো. আব্দুল্লাহ (৫৯), মনিরা ইয়াসমিন (৪৩), মো. জাহিদ হাসান (৪২), স্বপন মিয়া (৩৮), শাহজাহান (২৫), মিজানুর রহমান (৫০), বাদশা ওরফে সুলাইমান (২৬), ইমাম হোসাইন (৩৫), আব্দুর রাজ্জাক ওরফে আনারুল ইসলাম (৪২), মিজানুর রহমান (৩৯), ফারুক উদ্দিন (৪৭), আঞ্জুমানআরা বেগম (৫২), শেখ রবিন (৩৩), ইমাম হোসাইন (৩৫) ও মোছা. আছমা বেগম (৩৫)।
অভিযানে প্রতারণায় ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রীসহ দুটি ল্যাপটপ, একটি প্রজেক্টর, কোম্পানির ব্যবহৃত দুটি সিল, কোম্পানির ব্যানার দুটি, বিভিন্ন ধরনের চারটি ডায়েরি ও খাতা, একটি রেজিস্ট্রার খাতা, কোম্পানির ১২৫টি লিফলেট, প্রতারণায় ব্যবহৃত সুইসড্রাম কোম্পানির ভুয়া ওষুধ/প্রসাধনী সামগ্রী, সুইসড্রাম কোম্পানির ২৫ সেট ডিস্ট্রিবিউটর ওয়ার্কিং ফাইল, ২৩টি মোবাইল ফোন এবং নগদ এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৫ টাকা জব্দ করা হয়।
র্যাব-৪- এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
তিনি বলেন, প্রতারণার নতুন নতুন কৌশল ব্যবহার করে সাধারণ জনগণকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এক শ্রেণির পেশাদার প্রতারক চক্র। সম্প্রতি মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ও ই-কমার্স ব্যবসার মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে দেশ জুড়ে সমালোচিত হয়েছে ই-কমার্স ব্যবসা। এমএলএম এবং ই-কমার্স ব্যবসা নিয়ে যখন সারাদেশে ব্যাপক আলোচনা ও তর্ক-বিতর্ক চলছে, সাধারণ মানুষ যখন অনলাইন প্রতারণার ফাঁদে পড়ে অসহায় ও বিব্রত ঠিক এ মুহূর্তে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে পল্টন এলাকা থেকে সুইসড্রাম কোম্পানির অন্যতম পরিচালক কাজী আল-আমিনসহ মোট ১৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
তিনি বলেন, এ প্রতারক চক্রটি সুইসড্রাম কোম্পানির নামে একটি ওষুধ (সর্ব রোগের মহৌষধ) যা ক্যান্সার, ডায়াবেটিস ও হার্টের ওষুধ বলে প্রচারণা চালিয়ে আসছিল। এমনকি এ ওষুধ করোনা প্রটেক্টিভ হিসেবে কাজ করে বলেও প্রচার করে এ কোম্পানিটি।
কোম্পানিতে নতুন সদস্যদের পাঁচটি ক্যাটাগরির মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত করা হতো। ১ ও ২ ক্যাটাগরিতে ৪ হাজার ২০০ থেকে ৬ হাজার ২০০ টাকার বিনিময়ে এক প্যাকেট ওষুধ ও ৩, ৪ নম্বর ক্যাটাগরিতে ২৬ হাজার ২০০ থেকে ৫৮ হাজার টাকার বিনিময়ে ৬ থেকে ১৪ প্যাকেট ওষুধ এবং ৫ নম্বর ক্যাটাগরিতে ১ লাখ ১৭ হাজার টাকার বিনিময়ে ২৮ প্যাকেট ভুয়া ওষুধ দিয়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিল সুইসড্রাম কোম্পানি। যদিও প্রতিষ্ঠানটি নির্দিষ্ট কোনো সাইনবোর্ড ও ঠিকানা নেই।
প্রতারণার কার্যপদ্ধতি:
টার্গেট বা সদস্য সংগ্রহ: এ প্রতারক চক্রের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মী/সদস্য রয়েছে। তারা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বেকার ও অস্বচ্ছল তরুণ-তরুণী এমনকি শিক্ষিত লোকজনকে স্বল্প সময়ে অধিক মুনাফা লাভের প্রলোভন দেখিয়ে প্লাটিনাম, গোল্ড, সিলভার ও সাধারণ সদস্য হিসেবে অর্ন্তভুক্ত করে। কথাবার্তায় পটু, আর্থিকভাবে মোটামুটি স্বচ্ছলদের সদস্য সংগ্রহের জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়। তাদের মোটা অংকের টাকা দিতে বাধ্য করে এবং নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে ব্যাপক অর্থ আত্মসাৎ করা হয়।
পরের ধাপে, গ্রেফতার কাজী আল-আমিন দামি ব্র্যান্ডের গাড়ি নিয়ে কোম্পানির নতুন সদস্যদের কাছে প্রবাসী এবং বিভিন্ন দপ্তরের পদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতেন। তাদের প্রলুব্ধ করে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে মনোনয়ন দিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিতো। ভুক্তভোগীদের প্রলুব্ধ করে এবং তথ্যাদি সংগ্রহ করে ভুলিয়ে বিভিন্ন কৌশলে প্রতারক চক্রের কার্যালয়ে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হতো। এদের গ্রাহক/টার্গেট সংগ্রহের জন্য নির্দিষ্ট অংকের টাকা দেওয়ার কথা বলে প্রতারণা করা হতো এবং অধিক মুনাফা লাভের স্বপ্ন দেখানো হতো।
প্রতারণার কৌশল:
সভা/সেমিনার/মোটিভেশনাল ওয়ার্কশপ/আকর্ষনীয় লাঞ্চ ও বুফে ডিনার পার্টির আয়োজন করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল এবং রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় আকর্ষনীয় রেস্টুরেন্টে ভিকটিমদের নিয়ে এসে প্রতারণামূলক সভা/সেমিনার/মোটিভেশনাল ওয়ার্কশপ/আকর্ষনীয় লাঞ্চ ও ডিনার পার্টির আয়োজন করতো প্রতারক চক্রটি। অসহায়, নিরীহ অর্ধ-শিক্ষিত এমনকি শিক্ষিত শ্রেণির ভিকটিমরা এধরনের জাঁকালো আয়োজনে প্রলুব্ধ হয়ে খুব সহজেই তাদের প্রতারণার ফাঁদে পা দিতেন। র্যার-৪- এর সিও অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক বলেন, আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, সুইসড্রাম কোম্পানি মধ্যশিক্ষিত বেকার ও নিরীহ যুবক এবং শিক্ষিত সরল শ্রেণির লোকজনদের মোটিভেশনাল বক্তব্য দিয়ে ও মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে সদস্য হিসেবে সুইসড্রাম অ্যাপ- এ অ্যাকাউন্ট খোলার মাধ্যমে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন পরিচালক কাজী আল-আমিন। প্রতারণার কৌশল হিসেবে তারা ঘন ঘন তাদের অফিস পরিবর্তন করতো।
সুইসড্রাম কোম্পানির বিরুদ্ধে যতো অভিযোগ:
কোম্পানির সব কার্যক্রম প্রতারণামূলক। এ কোম্পানির পণ্যগুলো বিএসটিআই অনুমোদিত নয়। কোম্পানির পণ্য ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর কর্তৃক অনুমোদিত নয়। পণ্য আমদানি সংক্রান্তে উক্ত কোম্পাণির কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই। কোম্পানির পণ্য সম্পর্কে কোনো নোটিফিকেশন/ডিক্লারেশন নেই। কোম্পানি কর্তৃক সরকারি ভ্যাট/ট্যাক্সও দিতো না।গ্রেফতার আসামিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও জানান র্যাব-৪- এর সিও মোজাম্মেল।