ঢাকা: পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিনের মালিক হওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের সঙ্গে এক নতুন নিরাপত্তা চুক্তি করেছে অস্ট্রেলিয়া। অস্ট্রেলিয়া কেন মনে করছে যে তার এই সাবমেরিন পেতেই হবে?এখানে কি শুধুই অস্ট্রেলিয়ার স্বার্থ কাজ করেছে-নাকি এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রেরও সুদূরপ্রসারী কৌশলগত হিসাব-নিকেশ কাজ করছে?সেই হিসাব-নিকেশকে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য এতটাই গুরুত্ব দিচ্ছে যে শুধু চীনের চোখ-রাঙানিকেই তারা উপেক্ষা করছে তা নয়, তাদের নেটো মিত্র ফ্রান্সকেও ক্ষেপিয়ে তুলতে দ্বিধা করেনি।
চুপিসারে এবং অত্যন্ত গোপনে এ চুক্তির আলোচনাগুলো করা হয়-আর তা ঘোষণার ঠিক আগে একেবারে শেষ মুহূর্তে ফ্রান্সকে স্তম্ভিত করে অস্ট্রেলিয়া জানিয়ে দেয়-তারা ফ্রান্সের কাছ থেকে ১২টি ডিজেলচালিত সাবমেরিন কেনার জন্য করা চার হাজার কোটি ডলারের চুক্তিটি বাতিল করছে।
আমেরিকা, ব্রিটেন, ইউরোপ আর এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা একে বলছেন, এক মোড়-বদলকারী ঘটনা, যা পূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত-মহাসাগরীয় অঞ্চলের কৌশলগত হিসাব-নিকেশ পাল্টে দেবে।
‘চুক্তিভঙ্গ’,‘পিঠে ছুরিকাঘাত’, ‘বেইমানি’- এরকম কথা শুনতে হয় হোক, পারমাণবিক সাবমেরিন আমাদের লাগবেই’ - অস্ট্রেলিয়ার ভাবখানা ছিল এই রকমই। কেন?
পারমাণবিক সাবমেরিন শক্তিধর দেশগুলোর জন্য কেন এত জরুরি?
পৃথিবীতে এখন মাত্র ছয়টি দেশের হাতে পারমাণবিক সাবমেরিন আছে। এরা হলো, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও ভারত।
এর সুবিধাটা কী? সহজ কথায়, পরমাণু-শক্তিচালিত সাবমেরিন শত্রুপক্ষের চোখ এড়িয়ে গভীর সমুদ্রের নিচে ডুবে থাকতে এবং দ্রুত চলাচল করতে পারে-আর তার উপস্থিতি চিহ্নিত করাও অনেক কঠিন।
সাধারণ সাবমেরিনের সীমাবদ্ধতা হচ্ছে-এগুলো হয় ডিজেল বা বৈদ্যুতিক শক্তিচালিত। ডিজেল ইঞ্জিনে জ্বালানি পোড়ানোর জন্য বাতাস দরকার, আর ইলেকট্রিক ইঞ্জিনের জন্য ঘন ঘন রিচার্জ করা দরকার।
এ কারণে সবচেয়ে উন্নত ধরনের 'কনভেনশনাল' সাবমেরিনও এক নাগাড়ে কয়েক দিনের বেশি পানির নিচে ডুবে থাকতে পারে না। তাদের জ্বালানির জন্য পানির ওপর ভেসে উঠতে হয় বা বাতাস নেবার নলটিকে পানির ওপরে ভাসিয়ে রাখতে হয়। ফলে তা শত্রুপক্ষের চোখে ধরা পড়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
অন্যদিকে, এখন যেসব পারমাণবিক সাবমেরিন তৈরি হচ্ছে-সেগুলো কোনো রিফুয়েলিং ছাড়াই মাসের পর মাস পানির নিচে থাকতে পারে। এগুলো অনেক বেশি ক্ষেপণাস্ত্র বহন করতে পারে এবং তা অনেক বেশি দূর পর্যন্ত নিক্ষেপ করতে পারে।
সুতরাং পরমাণু-শক্তিচালিত সাবমেরিনের মালিক হবার পর অস্ট্রেলিয়ান সামরিক বাহিনীর সক্ষমতা অনেক বেড়ে যাবে। তারা অস্ট্রেলিয়ার আশপাশে প্রশান্ত মহাসাগরের বহুদূর পর্যন্ত এলাকায় গোপন নজরদারি ও টহল দিতে পারবে।
অস্ট্রেলিয়া মনে করছে, এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব ও হুমকি এতটাই বেড়ে গেছে যে তা মোকাবিলা করতে হলে ঠিক এই জিনিসটাই তাদের দরকার, ডিজেলচালিত সাবমেরিনে তাদের চলবে না।
এই সাবমেরিনে কী অস্ত্র থাকবে?
অস্ট্রেলিয়া পারমাণবিক অস্ত্রমুক্তকরণ চুক্তিতে স্বাক্ষর দানকারী একটি দেশ। তাই তাদের পক্ষে পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হওয়া বা তা মোতায়েন করা নিষিদ্ধ। সে কারণে বাইডেন এবং মরিসন উভয়েই বলেছেন যে অস্ট্রেলিয়া এই সাবমেরিনে পারমাণবিক অস্ত্র বহন করা হবে না।
তাই মনে করা হচ্ছে, খুব সম্ভবত এই পারমাণবিক সাবমেরিনে প্রচলিত, সাবমেরিন-থেকে নিক্ষেপযোগ্য ক্রুজ মিসাইল থাকবে।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেহেতু এটি পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন-তাই এতে যদি শুধু প্রচলিত অস্ত্রই থাকে এবং এতে কোন বিদেশি ক্রু না-ও থাকে-তার পরও এটা প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় নৌ-শক্তির ভারসাম্য বদলে দিতে পারবে।
এগুলো তৈরি হবে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার এডিলেইডে এবং এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য প্রযুক্তি ও পরামর্শ দেবে। কমপক্ষে আটটি সাবমেরিন তৈরি হবে, তবে এগুলো কোথায় মোতায়েন হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়।
সময়টা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ
বিশ্লেষকরা বলছেন, অস্ট্রেলিয়াকে পারমাণবিক সাবমেরিন তৈরি করতে দেবার মধ্যে দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের দাবিকে চ্যালেঞ্জ করতে এক বিশাল পদক্ষেপ নিয়েছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
‘পারমাণবিক অ্যাটাক সাবমেরিন পাওয়া এক বিরাট ব্যাপার এবং তা এক বিরাট বার্তা দিচ্ছে-নিউইয়র্ক টাইমসকে বলছেন ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অধ্যাপক বিপিন নারাং।
তিনি বলছেন, ‘পাঁচ বছর আগে এটা কল্পনা করাও কঠিন ছিল। আর ১০ বছর আগে তা ছিল অসম্ভব ব্যাপার এবং এ থেকে ওই অঞ্চলে চীনের আচরণ কেমন-তারও একটা আন্দাজ পাওয়া যায়।
এক ‘নতুন স্নায়ুযুদ্ধ?’
ওয়াশিংটন ও লন্ডন থেকে অবশ্য বলা হচ্ছে, এই পদক্ষেপের লক্ষ্য চীন নয়। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, অস্ট্রেলিয়াকে এ প্রযুক্তি দেয়ার পেছনে চীনকে ঠেকানো ছাড়া আর কোন কারণ থাকতে পারে না।
সাবেক অস্ট্রেলিয়ান প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা অধ্যাপক হিউ হোয়াইট বলছেন, এক নতুন স্নায়ু যুদ্ধের কথা।
তিনি বলেন, এর মধ্যে দিয়ে এই অনুভূতি গভীর হচ্ছে যে এশিয়াতে সত্যি এক নতুন স্নায়ুযুদ্ধ হচ্ছে এবং তাতে যুক্তরাষ্ট্রই জিতবে বলে অস্ট্রেলিয়া বাজি ধরেছে। চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত ব্যবস্থার সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া যুক্ত এবং এটা হলো তাকে আরো গভীর করার এক সিদ্ধান্ত। "
"এটা এক বিরাট চুক্তি-কারণ এই তিনটি দেশ ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকায় চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ মোকাবিলার জন্য কাজ শুরু করলো"-বলছিলেন অস্ট্রেলিয়ার নর্দার্ন টেরিটরি সরকারের প্রতিরক্ষা ও জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক সিনিয়র পরিচালক গাই বোকেনস্টাইন।
চীন-অস্ট্রেলিয়া সম্পর্ক কেন খারাপ হলো?
চীন ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে বড় বাণিজ্যিক অংশীদারিত্ব আছে এবং বহু চীনা ছাত্র অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা করে।
কিন্তু এই সাবমেরিন চুক্তির পর ‘অস্ট্রেলিয়া এখন নিজেকে চীনের বৈরী দেশে পরিণত করেছে’-মন্তব্য করেছে চীনের গ্লোবাল টাইমস দৈনিক।
করোনাভাইরাস মহামারির উৎস সন্ধানের এক বৈশ্বিক তদন্তে অস্ট্রেলিয়া সমর্থন দেবার পরই দু’দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক খারাপ হয়। এরপরই দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিত্রতা গভীরতর করতে যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া।
‘পারমাণবিক সাবমেরিন পেলেই অস্ট্রেলিয়া যে চীনের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়ে যাবে তা নয়," -বলছেন ইউ সান, "তবে এতে ওই অঞ্চলের ক্ষমতার ভারসাম্য পাল্টে যাচ্ছে। ’