দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় সম্পৃক্ত করে কর্মসংস্থানসহ অন্যান্য সুবিধা দিতে সারা বিশ্বে সংরক্ষণ করা হয় কোটা। কিন্তু কোটা পদ্ধতির সংস্কার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এ প্রথা বাতিল করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।এরপর থেকে দেশের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়ার পুরোটাই হচ্ছে মেধার ভিত্তিতে। তবে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির নিয়োগে এখনও বহাল আছে কোটা পদ্ধতি।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী আর শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটা সংরক্ষণ করাটা জরুরি। না হলে সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন। সুযোগ না পেলে অনগ্রসররা আরও পিছিয়ে যাবে বলেও মনে করেন তারা।
কোটা পদ্ধতির সংস্কার চেয়ে নানা সময় দেশে আন্দোলন দেখা গেলেও ২০১৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে এ দাবির পক্ষে বাড়তে থাকে জনমত। ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র সংরক্ষণ পরিষদ’-এর ব্যানারে শুরু হওয়া আন্দোলনে যোগ দিতে থাকেন বিভিন্ন পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। শিক্ষাঙ্গনে শুরু হয় অচলাবস্থা। অবরুদ্ধ সড়কে শুরু হয় তীব্র যানজট। দুর্ভোগে পড়তে হয় নগরবাসীকে।
এমন বাস্তবতায় ২০১৮ সালের ১১ এপ্রিল সংসদে দাঁড়িয়ে কোটা পদ্ধতি বাতিলের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ওই দিন সরকারদলীয় সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকের প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সংস্কার সংস্কার বলে...সংস্কার করতে গেলে আরেক দল এসে বলবে আবার সংস্কার চাই। কোটা থাকলেই সংস্কার। আর কোটা না থাকলে সংস্কারের কোনো ঝামেলাই নাই। কাজেই কোটা পদ্ধতি থাকারই দরকার নাই।’
ওই বছরের ৪ অক্টোবর কোটা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘৯ম গ্রেড (পূর্বতন প্রথম শ্রেণি) এবং ১০ম-১৩তম গ্রেডের (পূর্বতন দ্বিতীয় শ্রেণি) পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ করা হইবে।‘৯ম গ্রেড (পূর্বতন প্রথম শ্রেণি) এবং ১০ম-১৩তম গ্রেডের (পূর্বতন দ্বিতীয় শ্রেণি) পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হইল।’
এ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘কোটার যে বিষয়টি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পরিষ্কার করেছেন। সেভাবেই কিন্তু আমরা কোটা পদ্ধতি বাস্তবায়ন করছি। বিশেষ করে প্রথম শ্রেণির চাকরি, সেটা নবম গ্রেড থেকে শুরু করে ত্রয়োদশ গ্রেড পর্যন্ত মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া করে থাকি আমরা।’
তিনি বলেন, ‘বিসিএস ক্যাডার হয়ে যারা ঢুকছেন, তারা কিন্তু নবম গ্রেডে ঢোকেন। সেখান থেকে শুরু করে প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণি চাকরির ক্ষেত্রে কোটার কোনো বিষয় নেই। এটা পুরোপুরি মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ কাজ সম্পন্ন হয়।’
তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে দ্বিতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণি অর্থাৎ ১৪ থেকে ২০তম গ্রেডে কোটা পদ্ধতি বহাল আছে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।১৩ থেকে ২০তম গ্রেড পর্যন্ত কোটা পদ্ধতির বিন্যাস তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘এতিম এবং প্রতিবন্ধী যারা রয়েছেন তাদের জন্য ১০ শতাংশ রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা কোটা সেখানে ৩০ শতাংশ আছে। নারী কোটা ১৫ শতাংশ। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী যদি কেউ থাকেন, সেটা ৫ শতাংশ এবং আনসার ভিডিপির জন্য ১০ শতাংশ। অবশিষ্ট যা আছে ৩০ শতাংশ।’
উদাহরণ হিসেবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘কোনো জেলায় যদি ২০ জন নিয়োগ হয়, একজন এতিম ও একজন প্রতিবন্ধী মিলিয়ে দুই জন। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় হবে ছয় জন। তারপর নারী কোটায় তিন জন। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী যদি কেউ থাকে, সেখান থেকে এক জন। আনসার ভিডিপি থেকে থাকবে দুই জন এবং অন্যান্য সাধারণ যারা, যারা মেধার সঙ্গে আছেন তারা থাকবেন ছয় জন। ২০ জন এভাবেই বিভক্তি হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. আখতার হোসেন বলেন, ‘সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের জন্য অবশ্যই কোটা থাকা উচিত। কারণ মূলধারার সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ত করার সুযোগ থাকতে হবে।’
তাদের মূল স্রোতের সঙ্গে মেশাতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব নয় বলেও মনে করেন এই শিক্ষাবিদ।বিষয়টি প্রতিমন্ত্রীর নজরে আনা হলে তিনি বলেন, ‘আপাতত যেটা আছে, সেটা তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণির ক্ষেত্রে আমরা রেখেছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে যদি সে রকম কোনো নির্দেশনা আগামীতে পাওয়া যায়, আমরা অবশ্যই সেভাবে নির্দেশনা বাস্তবায়ন করব।’