সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদ। এই প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে সারাদেশে প্রতিবন্ধী, দুস্থ, অসুস্থ, দরিদ্র ও অসহায় মানুষদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য সরকার প্রতি বছর একটি বড় অংকের অর্থ বরাদ্দ দিয়ে থাকে। কিন্তু এই সরকারি সহায়তার টাকা প্রতিবন্ধী, দুস্থ ও দরিদ্রদের পরিবর্তে যাচ্ছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের পকেটে।
জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদের মাধ্যমে সরকার বিভিন্ন নিবন্ধিত সংগঠন ছাড়াও ব্যক্তিবিশেষকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে। ব্যক্তিবিশেষকে দেয়া অনুদানের অর্থ ‘বাহক চেক’ এর মাধ্যমে হস্তান্তর করা হয়। আবেদনকারীদের প্রত্যেকের নামে ‘বাহক চেক’ ইস্যু হয় জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদ থেকে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির নামে ‘চেক’ ইস্যু হয় ঠিকই, কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের হাতে এই ‘চেক’ যায় না। এমনকি যাদের নামে ইস্যু হয় দুস্থ, অসহায়, প্রতিবন্ধী, অসুস্থ ও দরিদ্র ওই ব্যক্তিরা ‘চেক’ চোখেও দেখেন না। খবরও জানেনও না যে, তাদের নামে সরকারের তরফ থেকে কোনো অর্থসাহায্য দেয়া হয়েছে। দুস্থ, অসহায়, প্রতিবন্ধীদের এই অনুদানের টাকা আত্মসাত করছেন জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদ এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রেই এ অর্থ আত্মসাত করা হয়েছে ঠিকানাবিহীন মানুষের নামে। নির্দিষ্ট ছকে আবেদন করার নিয়ম থাকলেও এ নিয়মনীতি অনুসরণ করা হয় না। মোবাইল ফোন নম্বর, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, ঠিকানাসহ আবেদনকারীর বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ থাকা অপরিহার্য হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা নেই। জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদের কাছে অফিসিয়ালি এ বিষয়ে তথ্য চাওয়া হলেও তারা দিতে পারেননি।
গত তিন বছরে যাদের নামে অনুদানের চেক ইস্যু হয়েছে তাদের কারোই মোবাইল ফোন নম্বর দিতে পারেনি জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদ। জাতীয় পরিচয়পত্রের কপিও পরিষদের কাছে নেই। আর্থিক অনুদান পাওয়া শত শত বক্তির মধ্যে মাত্র গুটিকয়েকের ঠিকানা তারা দিতে পেরেছেন। যাদের ঠিকানা দেয়া হয়েছে ওই ঠিকানা অনুযায়ী খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানেনই না যে, তাদের নামে সরকারি অনুদানের অর্থের চেক ইস্যু হয়েছে সরকারি এই প্রতিষ্ঠান থেকে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদ কর্তৃক স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থাসমূহ (নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ ১৯৬১ এর আওতায় নিবন্ধন প্রাপ্ত বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক সংস্থাসহ অতি দরিদ্র ব্যক্তিদের প্রতিবছর বিভিন্ন পরিমাণে অনুদান প্রদান করা হয়। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসমূহের মধ্যে যে অনুদান প্রদান করা হয় তা মাঠ পর্যায়ে সমাজসেবা অধিদফতর কর্তৃক বাস্তবায়িত হয়। জেলা সমাজকল্যাণ পরিষদ ও উপজেলা সমাজকল্যাণ পরিষদ মূলতঃ মাঠপর্যায়ে বাংলাদেশ জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদ এর কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে থাকে। সমাজসেবা অধিদফতরের কর্মকর্তাগণ জেলা ও উপজেলা সমাজকল্যাণ পরিষদের প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
সংগঠন এবং ব্যক্তিবিশেষের সহায়তার জন্য প্রতি বছর সরকার জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদকে ৬০/৭০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। পরিষদের ‘বিশেষ অনুদান’ নামে একটি খাত আছে। সেটির বরাদ্দ দরিদ্র, দুস্থ, অসহায় ও প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য। একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত এই খাতের অনুদান পেতে পারেন। প্রতি বছর ৩০ শে অক্টোবরের মধ্যে জাতীয় দৈনিক পত্রিকা ও বিভিন্ন মিডিয়ায় জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদ কর্তৃক অনুদান প্রাপ্তির দরখাস্ত আহবান করা হয়। সমাজকল্যাণ পরিষদ কর্তৃক জেলা ও উপজেলা সমাজকল্যাণ পরিষদে অনুদানের দরখাস্ত করার নির্ধারিত ফরম এবং দরখাস্ত আহবানের নোটিশ প্রেরণ করা হয়। দুঃস্থ ব্যক্তিগণ সাদা কাগজে আবেদন করতে পারবেন। তবে সেক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ছক অনুসরণ করতে হবে। আবেদন পত্রসমূহ সংশ্লিষ্ট সমাজসেবা কার্যালয়ে জমা দিতে হয়। জেলা ও উপজেলা সমাজকল্যাণ পরিষদ কর্তৃক আবেদন বাছাই ও জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদে সুপারিশ প্রেরণ করার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু এই নিয়ম অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করা হয় না। ‘বিশেষ অনুদান’ খাত থেকে দুস্থ, অসহায়, দরিদ্র ও প্রতিবন্ধীদের নামে যে আর্থিক সাহায্য দেয়া হয় তাতে আবেদনের নিয়মগুলো ব্যাপকভাবে লঙ্ঘন করা হয়। ‘দুস্থ/ অসহায়/ প্রতিবন্ধী/ গরীবদের আর্থিক সাহায্যের আবেদন ফরম’ নাম একটি ফরম নির্দিষ্ট করা আছে। দুস্থ-অসহায় ব্যক্তিরা সাদা কাগজে দরখাস্ত করলেও ফরমের এই নিদিষ্ট ফরমেট অনুসরণ করার কথা। ফরমেট অনুযায়ী আবেদনপত্রে আবেদনকারীর নাম, পিতা-মাতার নাম. বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা ছাড়াও মোবাইল ফোন নম্বর, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর প্রভৃতি বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ থাকাটা বাধ্যতামূলক। কিন্তু এই নিয়ম মোটেই মানা হচ্ছে না।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১৭-২০১৮, ২০১৮-২০১৯ এবং ২০১৯-২০২০ এই তিন বছরে যেসব শত শত দুস্থ, অসহায়, দরিদ্র, প্রতিবন্ধী মানুষের নামে বিশেষ অনুদানের চেক ইস্যু হয়েছে তাদের অধিকাংশের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা নেই। মোবাইল ফোন নম্বর নেই। জাতীয় পরিচয়পত্র তো নেই-ই। কীভাবে এইসব অনুদান প্রাপকের হাতে ব্যাংক চেক হস্তান্তর করা হয়েছে এর কোনো জবাব দিতে পারেননি জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদের কর্মকর্তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এভাবে ব্যক্তিবিশেষকে দেয়া অনুদানের প্রায় পুরোটাই লুটপাট-আত্মসাত হচ্ছে। এমনকি সংগঠনগুলোর নামে যেসব অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয় তারও ভাগবাটোয়ারা আদায় করেন জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদ এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরা। সংগঠনগুলো যে কর্মসূচির বিপরীতে অনুদানের অর্থ পায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয় না। সমাজকল্যাণ পরিষদ এ বিষয়টি যথাযথভাবে তদারকও করে দেখে না, কর্মসূচি আদৌ বাস্তবায়িত হচ্ছে কিনা। যেহেতু মন্ত্রণালয় ও সমাজকল্যাণ পরিষদ আগে থেকেই ম্যানেজ করা থাকে।