আইনের কোনো প্রকার তোয়াক্কা না করেই বরখাস্তকৃত কর্মকর্তাদের চাকরিতে পুনর্বহাল করেছে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)। কিন্তু আইন বলছে, ‘আর্থিক সংশ্লেষ আছে এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে পরবর্তী পাঁচ বছর পদায়ন করা যাবে না’। এরপরও বরখাস্তকৃত কর্মকর্তাদের চাকরিতে বহাল এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এ বিষয়ে কিছু না জানানোকে নিয়মবহির্ভূত কাজ হিসেবেই দেখা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
পরিদর্শন প্রতিবেদনে দেখা যায়, ব্যাংটির মুখ্য কর্মকর্তা মো. আরিফ হোসেন মন্ডলকে ভুয়া ঋণ প্রদান, গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের কারণে ২০১৮ সালের ২৮ আগস্ট বরখাস্ত করেছিল রাকাব। একই অভিযোগে ব্যাংকটির কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদ-উল-বারিকেও ২০১৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বরখাস্ত করা হয়। আর্থিক অনিয়মে সংশ্লিষ্টতায় বরখাস্তকৃত এমন ব্যক্তিকে পরবর্তী পাঁচ বছর কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা যাবে না-এমন আইন থাকলেও এই দুই কর্মকর্তার বেলায় আইন অমান্য করা হয়েছে।
বরখাস্তের আড়াই বছরের মাথায় ২০২০ সালের ৭ জানুয়ারি রাকাবের ৪৮৭তম পর্ষদ সভায় মো. আরিফ হোসেন মন্ডলকে পুনর্বহাল করা হয়। আর বরখাস্তের ৬ মাসের মাথায় ২০১৮ সালের ১৩ আগস্ট রাকাবের ৪৮০তম পর্ষদ সভায় সাজ্জাদ-উল-বারিকে পুনর্বহাল করা হয়। ভুয়া ঋণ প্রদান, গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎ ও তৎসংশ্লিষ্ট অভিযোগও প্রমাণিত হওয়ায় চাকরি হতে বরখাস্ত করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে শাস্তিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদ্বয়ের আবেদনের প্রেক্ষিতে পুনরায় চাকরিতে বহাল করা হয়।
তবে আইন অমান্য করে আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের চাকরিতে পুনর্বহাল হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ব্যাংটির অন্যান্য কর্মকর্তারা। এর মাধ্যমে অন্যরাও অনিয়ম করতে উৎসাহ পাবে বলে মন্তব্য তাদের। একই সঙ্গে বরখাস্তকৃত কর্মকর্তাদের চাকরিতে পুনর্বহাল হওয়ায় একটি দুষ্টুচক্রের সঙ্গে মোটা অঙ্কের লেনদেনও করেছেন ওই দুই কর্মকর্তা- এমন অভিযোগও রয়েছে ব্যাংটিতে।
এ বিষয়ে মো. আরিফ হোসেন মন্ডল বলেন, ‘পুরোনো ১০-১২টা শস্যঋণ ছিল, সেখানে অনিয়ম ছিল। আমার কাছে সেসব অনিয়ম ধরা অসম্ভব ছিল। আমার যোগদানের আগেই সেসব লোন দেওয়া হয়েছিল। আমি যোগদানের পর নতুন লোন দেওয়া হলে সেখানকার অনিয়মগুলো তুলে ধরি। পরে ব্যাংক আমাকে চাকরিতে আবারও পুনর্বহাল করেছে, এখন চাকরি করছি।’
এই দুই কর্মকর্তা ছাড়াও রাকাবের ঊর্ধ্বতন মুখ্য কর্মকর্তা মুকুল কুমার বর্ধন ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা শেখ তৌফিক এলাহীর মঞ্জুরীকৃত শ্রান্তি বিনোদন ছুটি আংশিক ভোগের পর তা বাতিল করে অফিসে যোগদান করেন। এ সময়ে তারা লাঞ্চভাতা ভোগ করেছেন, করেছেন নানা ঋণ অনিয়ম। তাদের ভাতাভোগ সম্পন্ন অবৈধ বলছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।শ্রান্তি বিনোদন হলো সরকারি চাকরিজীবীরা তাদের যোগদানের তারিখ থেকে প্রতি তিন বছর পরপর ১৫ দিনের ছুটিসহ এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পেয়ে থাকেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শনে উঠে এসেছে, রাকাবের ঊর্ধ্বতন মুখ্য কর্মকর্তা মুকুল কুমার বর্ধনের মঞ্জুরীকৃত ১৫ দিনের শ্রান্তি বিনোদন ছুটি অনুমোদন হয় ২০১৮ সালের ৮ এপ্রিল থেকে। তিনি সাতদিন ছুটি ভোগ করে একই মাসের ১৫ তারিখে কর্মস্থলে যোগদান করেন। আর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা শেখ তৌফিক এলাহীর শ্রান্তি বিনোদন ছুটি অনুমোদন হয়েছিল ২০১৮ সালের ২৩ মার্চ। তিনি নয়দিন ছুটি ভোগ করার পর ছুটি বাতিল করে একই বছরের ১ এপ্রিল কাজে যোগদান করেন।
কিন্তু রাকাব শ্রান্তি বিনোদন ছুটি ও ভাতা মঞ্জুরী নীতিমালা, ২০১৬ এর অনুচ্ছেদ ১০ অনুসারে, যদি কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী শ্রান্তি বিনোদন ছুটি ও ভাতা মঞ্জুরী প্রাপ্য হন কিন্তু ব্যাংকেকর স্বার্থে তাকে তার সুবিধাজনক সময় ছুটি ও ভাতা সমন্বয় করা সম্ভব না হয় তবে তাকে যথাশিগগির সম্ভব এ ছুটি ও ভাতা মঞ্জুর করা যাবে।অনুচ্ছেদ ১১ অনুসারে, বিনোদন ভাতা প্রদানের মূল শর্ত হলো যুগপৎভাবে শ্রান্তি ও বিনোদন ছুটি মঞ্জুরী। অতএব শ্রান্তি বিনোদন ছুটি মঞ্জুরী ব্যতিরেকে বিনোদন ভাতা প্রদান করা যাবে না।
এ বিষয়ে মুকুল কুমার বর্ধন বলেন, ‘এখানে বলার কিছু নেই, অনেক বিষয় থাকে। তবে কিছু মানুষ আছে যারা একে অপরকে সহ্য করতে পারে না, তারা এ ধরনের অভিযোগ করেন। তাছাড়া আমার শ্রান্তি বিনোদন ছুটির সময়ে চেয়ারম্যানের ট্যুর প্রোগ্রাম ছিল। সঙ্গত কারণে আমাকে সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের অভিযোগের পরে আমি যে লাঞ্চভাতা নিয়েছিলাম, সেসব টাকা ফেরত দিয়েছি।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন তথ্য বলছে, ঊর্ধ্বতন মুখ্য কর্মকর্তা মুকুল কুমার বর্ধন এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা শেখ তৌফিক এলাহী শ্রান্তি বিনোদন ছুটি ও ভাতা গ্রহণ করে কিছুদিন পর সেই ছুটি বাতিল করে পুনরায় কাজে যোগদান করেন। নিয়মিতভাবে কর্মকালীন লাঞ্চ (দুপুরের খাবার) বিল গ্রহণ করে যুগপৎভাবে ভাতা গ্রহণের সুবিধা নিয়েছেন, যা অবৈধ। একই সঙ্গে এ বিষয়ে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ব্যাংক ব্যবস্থাপনাকে পরামর্শ প্রদান করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এসব অভিযোগের বিষয়ে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘আমার অনেক ব্র্যাঞ্চ আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ইন্সপেকশন থাকতে পারে। তবে অভিযোগ বিষয়ে আমাকে নথি দেখে বলতে হবে। নথি ছাড়া কিছু বলতে পারবো না। তাছাড়া ব্যাংকের ইন্সপেকশন বাংলাদেশ ব্যাংকে দেয়া হবে, নিউজ করার কী আছে?’