১৫ আগস্ট, নির্মমতার চূড়ান্তরূপ দৃশ্যায়নের দিন। জাতির পিতাকে সপরিবারে নৃশংস হত্যাযজ্ঞের দিন। বাংলা ও বাঙালির চরম ট্র্যাজেডির দিন। দিনটি এলেই ভেসে ওঠে কিছু নরপিশাচের ঘৃণ্য রূপ। যাদের মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে, কিন্তু কার্যকর করা যায়নি। চলতি বছর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে বাংলাদেশ। কিন্তু স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা মামলার রায় পুরোপুরি কার্যকর করা যায়নি এখনো।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়ে ১২ জন আসামির মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ছয়জনের রায় কার্যকর করা হয়েছে। একজন বিদেশে মারা গেছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। বাকি পাঁচজন এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার বলছে, খুনিদের দুইজন-রাশেদ চৌধুরী ও নূর চৌধুরী যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় বসবাস করছেন। তাদের ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকরের বিষয়টি ‘আইনি মারপ্যাঁচে’ আটকে আছে। বাকি তিন খুনি- আব্দুর রশীদ, শরীফুল হক ডালিম ও মোসলেম উদ্দিনের অবস্থান সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ বিষয়ে বিভিন্ন দেশ, প্রবাসী এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা চেয়েছে সরকার।
বাংলাদেশ পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স বলছে, ‘বঙ্গবন্ধুর খুনি লে. কর্নেল (অব্যাহতি) এস এইচ এম বি নূর চৌধুরীর অবস্থান কানাডায়। আরেক আসামি লে. কর্নেল (অব্যাহতি) এ এম রাশেদ চৌধুরীর অবস্থান করছেন যুক্তরাষ্ট্রে। বাকি তিন খুনি লে. কর্নেল (অব্যাহতি) শরিফুল হক ডালিম, লে. কর্নেল (বরখাস্ত) খন্দকার আব্দুর রশিদ ও রিসালদার (অব.) মোসলেহ উদ্দিনের অবস্থান শনাক্ত করা যায়নি। তবে ২০০৯ সাল থেকে তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারি করা আছে, যার মেয়াদও যথাসময়ে বৃদ্ধি করা হয়।’
এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘পাঁচ খুনি এখনো বাইরে আছে। দুইজনের খবর আমরা জানি; একজন রাশেদ চৌধুরী, আছেন আমেরিকায়। আরেকজন নূর, কানাডায় আছেন। তাদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আইনের মারপ্যাঁচ আছে। আমাদের যে প্রচেষ্টা দরকার, আমরা করছি। আমাদের আইনমন্ত্রীও এ ব্যাপারে অত্যন্ত তৎপর।’
তিনি বলেন, ‘বাকি তিনজন কোথায় আছে আমরা জানি না। বিভিন্ন সময়ে অমুক জায়গায়, তমুক জায়গায় আছে বলে বলা হয়, পরে সেখানে তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করলে পাওয়া যায় না। আমরা দেশবাসী ও সব প্রতিষ্ঠনকে অনুরোধ করেছি, সব রাষ্ট্রদূতকে চিঠি দিয়েছি, প্রবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে তাদের চিহ্নিত করতে, তাদের অবস্থান নিশ্চিত হলে ব্যবস্থা নিতে পারবো।’
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মুখপাত্র ও দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বলছেন একই কথা। তিনি বলেন, ‘১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের খুনিরা বিচারের মুখোমুখি হয়েছে। কয়েকজন খুনির ফাঁসির রায়ও কার্যকর করা হয়েছে। কিন্তু এখনো কয়েকজন বিদেশে পলাতক, তাদেরকে ফিরিয়ে আনার সর্বাত্মক কূটনৈতিক প্রয়াস অব্যাহত আছে।’
বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনিকে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ ও অগ্রগতি জানতে চাইলে পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-এনসিবি) মহিউল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘এনসিবি, ঢাকা কর্তৃক উল্লখিতি আসাসিদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি রয়েছে। লে. কর্নেল এস. এইচ. এম. বি নূর চৌধুরী ও লে. কর্নেল এ. এম রাশেদ চৌধুরীকে কূটনৈতিক তৎপরাতার মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবের মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর পত্র প্রেরণ করা হয়েছে। তাদের বিষয়ে ইন্টারপোল কানাডা, ইন্টারপোল ওয়াশিংটন এবং ইন্টারপোল সদর দফতরের সঙ্গে এনসিবি-ঢাকার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ অব্যাহত আছে।’
তিনি বলেন, ‘বাকি তিনজন-লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম, লে. কর্নেল খন্দকার আব্দুর রশিদ এবং রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন কোন দেশে অবস্থান করছে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রাপ্তি সাপেক্ষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হবে। এ ব্যাপারে এনসিবি-ঢাকা সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে।’
এছাড়াও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামিদের বাংলাদেশে আনার বিষয়ে পর্যালোচনা ও এ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে উচ্চ পর্যায়ের সমন্বয়ে গঠিত টাস্কফোর্সের সর্বশেষ সভা গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন মেঘনায় অনুষ্ঠিত হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ দিয়ে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বাঁচানোর পক্রিয়া করা হয় ৭৫’ পরবর্তী বাংলাদেশে। ৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার সেটি বাতিল করে। তখন বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী মহিতুল ইসলাম ধানমন্ডি থানায় এ নিয়ে একটি হত্যা মামলা করেন। সেই মামলায় ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন।
আপিলের রায়ে এই ১৫ জনের মধ্যে তিনজন খালাস পান। বাকি যে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে উচ্চ আদালত তারা হলেন- সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ, মহিউদ্দিন আহমদ, এ কে বজলুল হুদা, এ কে এম মহিউদ্দিন, আবদুল মাজেদ, আজিজ পাশা, আব্দুর রশীদ, শরীফুল হক ডালিম, মোসলেম উদ্দিন, রাশেদ চৌধুরী ও এবিএমএইচ নূর চৌধুরী।
তাদের মধ্যে প্রথম ছয়জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরা হয়েছে। তাদের একজন আজিজ পাশা পলাতক থাকা অবস্থায় দেশের বাইরে মারা গেছেন বলে সংবাদমাধ্যমে জানা গেছে। বাকি পাঁচজনের দণ্ড কার্যকর করতে চলছে নানা তৎপরতা।