প্রায় এক বছর ধরে ঊর্ধ্বমুখী ধারায় রয়েছে দেশের শেয়ারবাজার। ফলে লোকসান ভুলে একের পর এক মুনাফা তুলে নিচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। ইতোমধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বাড়ার মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের টাকা প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা বেড়ে গেছে। প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক দেড় হাজার পয়েন্টের ওপরে বেড়েছে।
শেয়ারবাজার এমন ছুটলেও সার্বিকভাবে বাজারকে ঝুঁকিমুক্ত বলছেন বিশেষজ্ঞরা। সেইসঙ্গে বর্তমান বাজারে বিনিয়োগ নিরাপদ বলেও অভিমত দিয়েছেন তারা। তবে কিছু কোম্পানির শেয়ার দাম অতিমূল্যায়িত হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন তারা। এ জন্য বিনিয়োগকারীদের সতর্কতার সঙ্গে বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন।
এক বছর ধরে ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও আমি মনে করি সার্বকভাবে বর্তমান শেয়ারবাজার বিনিয়োগের উপযুক্ত এবং বিনিয়োগের জন্য নিরাপদ। বর্তমানে সার্বিক শেয়ারবাজারের পিই রেশিও ১৫-এর নিচে আছে। এটা ২০ পর্যন্ত যাওয়া নিরাপদ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে সার্বিক শেয়ারবাজারের মূল্য-আয় অনুপাত বা পিই রেশিও ১৫-এর নিচে রয়েছে। পিই রেশিও ২০ না হওয়া পর্যন্ত বাজারে বিনিয়োগ নিরপদ বলা যায়। কিছু কোম্পানির শেয়ার দাম অস্বাভাবিক বাড়লেও বেশিরভাগ ভালো মৌলভিত্তির কোম্পানির শেয়ার দাম এখন বেশ কম রয়েছে। বিশেষ করে যেসব কোম্পানির পিই রেশিও ১৫-এর নিচে আছে সেগুলো বিনিয়োগের জন্য যথেষ্ট উপযুক্ত।
তারা বলছেন, প্রায় এক বছর ধরে শেয়ারবাজার ঊর্ধ্বমুখী ধারায় থাকলেও ২০১০ সালে বাজার যেভাবে ফুলে ফেঁপে উঠেছিল, বর্তমান বাজারে সেই অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু কিছু কোম্পানির শেয়ার দাম অস্বাভাবিক ভাবে বেড়েছে। এসব কোম্পানিতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ হুমড়ি খেয়ে বিনিয়োগও করছেন। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে অতিত থেকে বিনিয়োগকারীরা খুব একটা শিক্ষা গ্রহণ করেনি। এখনো আগের মতোই বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী গুজবভিত্তিক বিনিয়োগ করছেন।
তারা আরও বলছেন, বিনিয়োগকারীদের মনে রাখতে হবে শেয়ারবাজারে যেমন মুনাফা পাওয়া যায়, তেমনি লোকসানের শঙ্কাও রয়েছে। তাই নিজের বিনিয়োগ করা টাকা সুরক্ষার ব্যবস্থা বিনিয়োগকারীদের নিজেদেরই করতে হবে। এ জন্য এখনই সতর্ক হতে হবে। গুজব পরিহার করে কোম্পানির সার্বিক চিত্র ভালো করে পর্যালোচনা করে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেইসঙ্গে অতিরিক্ত মুনাফার লোভ পরিহার করে দুর্বল কোম্পানির পরিবর্তে ভালো মৌলভিত্তির কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে হবে।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হলে শেয়ারবাজারে ধস নামে। আতঙ্কে ওইদিন প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক ৯৭ পয়েন্ট পড়ে যায়। পরের দিন ৯ মার্চ আরও বড় ধস নামে শেয়ারবাজারে। একদিনে ২৭৯ পয়েন্ট কমে যায় ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক। এ সময় আতঙ্কে লোকসানে শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে অনেকে শেয়ারবাজার ছাড়েন। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারায় টানা ৬৬ দিন বন্ধ রাখা হয় শেয়ারবাজারের লেনদেন।
এর মধ্যেই বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম। তার সঙ্গে কমিশনার হিসেবে যোগদেন আরও তিনজন। নতুন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর শেয়ারবাজারে লেনদেন চালু করার উদ্যোগ নেন। সেইসঙ্গে বাজারে স্বচ্ছতা ফেরাতে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যার ফলে বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ে। এতে নতুন করে বিনিয়োগে ফেরেন অনেক বিনিয়োগকারী। পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকেও পলিসি সাপোর্ট দেয়া হয়।
ফলে পতন কাটিয়ে প্রায় এক বছর ধরে বড় ঊর্ধ্বমুখী ধারায় রয়েছে বাজার। মাঝে চলতি বছরের মার্চের শেষ ও এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে বাজারে কিছুটা মূল্য সংশোধন হলেও বাজার ঘুরে দাঁড়াতে খুব একটা সময় নেয়নি। সাম্প্রতি পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে কোন কোন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে বেড়ে দ্বিগুণ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। শেয়ারবাজারের এমন চিত্র ২০১০ সালের ধসের পর আর দেখা যায়নি। এতে করে বাজার থেকে বড় মুনাফা তুলে নেয়ার আশায় নতুন নতুন অনেক বিনিয়োগকারী ঢুকছেন।
বাংলাদেশে যেদিন প্রথম করনো শনাক্ত হয় অর্থাৎ গত বছরের ৮ মার্চ ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ছিল ৪ হাজার ২৮৭ পয়েন্টে। চলতি বছরের ১৩ জুন লেনদেন শেষে তা বেড়ে ৬ হাজার ৩৬ পয়েন্টে উঠে এসেছে। অর্থাৎ করোনার মধ্যে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক বেড়েছে ১ হাজার ৭৪৯ পয়েন্ট।
সূচকের পাশাপাশি বড় উত্থান হয়েছে বাজার মূলধনে। করোনার মধ্যে ডিএসইর বাজার মূলদন বেড়েছে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩৯ কোটি টাকা। বাজার মূলধন বাড়ার অর্থ তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার ও ইউনিটের দাম ওই পরিমাণ বেড়েছে। এ হিসেবে করোনার প্রকোপের মধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বাড়ার মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের টাকা প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা বেড়ে গেছে।
অবশ্য শেয়ারবাজারের এই তেজীভাবের মধ্যে কিছু কোম্পানির শেয়ার দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এক বছরের মধ্যে প্রায় নয়শ’ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাাড়র ঘটনা ঘটেছে। দুইশ’ শতাংশের পরে দাম বেড়েছে এমন প্রতিষ্ঠান রয়েছে প্রায় দুই ডজন। অস্বাভাবিক দাম বাড়ার এই তালিকায় অধিকাংশই রয়েছে সাধারণ বীমা কোম্পানি।
গত এক বছরে শেয়ার দামে বড় উল্লম্ফন হওয়া প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বেক্সিমকো, প্রভাতী ইন্স্যুরেন্স, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স, এশিয়া ইন্স্যুরেন্স, পাইওয়নিয়ার ইন্স্যুরেন্স, গ্লোবাল ইন্স্যুরেন্স, ফেডারেল ইন্স্যুরেন্স, ঢাকা ইন্স্যুরেন্স, ইষ্টার্ণ ইন্স্যুরেন্স, পূরবী জেনারেল ইন্স্যুরেন্স, নর্দান ইন্স্যুরেন্স, প্রাইম ইন্স্যুরেন্স, বিডি ফাইন্যান্স, ঢাকা ডাইং, ন্যাশনাল ফিড, ফরচুন সুজ।
শেয়ারবাজারের এই পরিস্থিতি ডিএসইর এক সদস্য বলেন, ২০১০ ধসের পর দীর্ঘদিন বাজার এক প্রকার মৃত অবস্থায় ছিল। গত এক বছরে বাজারে প্রাণ ফিরে এসেছে। বিনিয়োগকারীরা যেমন প্রতিনিয়ত মুনাফা তুলে নিচ্ছেন। তেমনি ব্রোকারেজ হাউজগুলোর আর্থিক আবস্থারও বেশ উন্নতি হয়েছে। এখন অনেকটা ২০০৯-১০ সালের মতোই রমরমা শেয়ারবাজার। বাজার ভালো থাকায় প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বিনিয়োগকারী বাজারে ছুটে আসছেন।
শেয়ারবাজারের এই পরিস্থিতি সম্পর্কে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, এক বছর ধরে ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও আমি মনে করে সার্বিকভাবে বর্তমান শেয়ারবাজার বিনিয়োগের উপযুক্ত এবং বিনিয়োগের জন্য নিরাপদ। বর্তমানে সার্বিক শেয়ারবাজারের পিই রেশিও ১৫-এর নিচে আছে। এটা ২০ পর্যন্ত যাওয়া নিরাপদ।
তিনি বলেন, অনেক ভালো কোম্পানির শেয়ার দাম এখনও বেশ কম দামে আছে। তবে কিছু কোম্পানির শেয়ার দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। এমন বাড়া ঠিক হয়নি। এই দাম বাড়ার পেছনে কারসাজি থাকতে পারে। এটা নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিএসইসির দেখা উচিত। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের উচিত অস্বাভাবিক দাম বেড়ে যাওয়া কোম্পানির বিষয়ে সচেতন হওয়া। তাদের উচিত ভালো করে তথ্য যাচাই-বাছাই করে মৌলভিত্তি সম্পন্ন শেয়ারে বিনিয়োগ করা। আমি মনে করি এখন পিই ১৫-এর নিচে থাকা কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা নিরাপদ।
বিএসইসির সাবেক আর এক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, সম্প্রতি কিছু কোম্পানির শেয়ার দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়লেও সার্বিকভাবে বর্তমান পুঁজিবাজার বিনিয়োগের জন্য যথেষ্ট নিরাপদ। এখনো বাজারে অনেক ভালো প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম বেশ কম রয়েছে। তবে একটি বিশেষ সেক্টরের বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ার দাম কারসাজির মাধ্যমে বাড়ানো হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের এ বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত।
তিনি বলেন, আমার কাছে মনে হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের আচরণের খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। বিভিন্ন বিনিয়োগ শিক্ষা কর্যক্রম চালানো হলেও, তা খুব একটা কাজে আসেনি। আগের মতোই এখনো বিনিয়োগকারীরা গুজবভিত্তিক বিনিয়োগ করছেন। যে কারণে ভালো প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম পেছনে পড়ে থাকলেও দুর্বল কোম্পানির শেয়ার দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে।
তিনি আরও বলেন, ২০১০ সালে শেয়ারবাজার যে অবস্থায় গিয়েছিল বর্তমান বাজার সেই অবস্থায় গিয়েছে বলে আমার মনে হয় না। তবে বিনিয়োগকারীদের আচরণের পরিবর্তন হওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে শেয়ারবাজারে যেমন মুনাফা করার সুযোগ আছে, তেমনি লোকসানের কবলেও পড়তে হতে পারে। সুতরাং নিজের পুঁজির নিরাপত্তার ব্যবস্থা বিনিয়োগকারীকেই করত হবে।
ডিএসইর পরিচালক মো. শাকিল রিজভী বলেন, শেয়ারবাজার ভালো করতে বিএসইসির নতুন কমিশন বেশকিছু ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আইপিওতে আবেদন করার ক্ষেত্রে কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা বিনিয়োগের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। এছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে পুঁজিবাজারে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগে সুযোগ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি আর্থনীতি তুলনামূলক ভালো অবস্থায় রয়েছে। ব্যাংকের সুদের হারও বেশ কম রয়েছে। সবকিছু মিলে গত এক বছরে শেয়ারবাজার ভালো করেছে।
তিনি বলেন, বাজার যখন ভালো থাকে তখন বিনিয়োগকারীরাও বিনিয়োগে উৎসাহিত হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের উচিত ভালো করে তথ্য যাচাই-বাছাই করে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়া। কোনো অবস্থাতেই গুজবের ওপর ভিত্তি করে বিনিয়োগ করা ঠিক না। বিনিয়োগের আগে কোম্পানির লভ্যাংশের অতীত ইতিহাস, পরিচালনা পর্ষদ, বর্তমান আর্থিক আবস্থা, পিই রেশিও সবকিছু ভালো করে বিশ্লেষণ করে নিতে হবে। ভালো শেয়ার বাছাই করে বিনিয়োগ করতে পারলে শেয়ারবাজার থেকে মুনাফা করা সম্ভব।