নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে কিশোর গ্যাং। একে অপরের ক্ষমতা দেখাতে কয়েকজন মিলে পাড়া-মহল্লায় বিভিন্ন নামে গ্যাং গ্রুপ গড়ে তুলছে। আধিপত্য বিস্তার, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, মাদক ও প্রেম নিয়ে বিরোধের জেরে তারা অহরহ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। অর্থের বিনিময়ে অর্থদাতার প্রতিপক্ষের ওপরও আক্রমণ চালাচ্ছে উঠতি বয়সী ছেলেরা। এমনকি কিছু অর্থের বিনিময়ে খুনোখুনিতেও জড়িয়ে পড়ছে তারা।
কিশোর গ্যাংয়ের সাম্প্রতিক সংঘর্ষের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় ‘বড় ভাই’রা। ‘হিরোইজম’ প্রকাশ করতে পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে। ঢাকায় আন্ডারওয়ার্ল্ডের খুনোখুনিতে কিশোর ও তরুণদের ব্যবহারের ঘটনাও ঘটছে।
সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে গত ২৯ মার্চ শবে বরাতের রাতে রাজধানীর সূত্রাপুর এলাকায় দুই কিশোর গ্যাংয়ের সংঘর্ষে অনন্ত (১৭) নামে এক কিশোর নিহত হয়। এ ঘটনায় আহত হয় সজল আহমেদ (১৬) নামের আরেক কিশোর।
এ দিন রাত ১১টার দিকে অনন্ত ও আহত সজল ফরাজগঞ্জ ঘাট এলাকায় অবস্থান করছিল। এ সময় স্থানীয় ফেরদৌস, আফসার ও সাকিবসহ ১০-১২ জন কিশোর তাদের দুজনের ওপর ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। মুখ, হাত ও পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম করে তাদের ফেলে পালিয়ে যায় তারা। পরে দুজনকেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অনন্ত মারা যায়। সিনিয়র-জুনিয়র নিয়ে অনন্তের সঙ্গে ফেরদৌস-আফসারদের দ্বন্দ্ব চলছিল। তারই জেরে এ ঘটনা ঘটে বলে ধারণা পুলিশের।
জানা গেছে, গত ১৭ বছরে ঢাকায় কিশোর অপরাধীদের হাতে ১২০ জন খুন হয়েছে। এর মধ্যে গত দুই বছরে খুন হয়েছে ৩৪ জন। এসব ঘটনায় চার শতাধিক কিশোরের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২০ সালে নানা কারণে সারাদেশে ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী ২৬৪ কিশোর নিহত হয়েছে। যেখানে ২০১৯ সালে একই বয়সী ছেলের নিহতের সংখ্যা ছিল ২২১ জন। এছাড়া ২০২০ সালে খুন হয় ৭ থেকে ১২ বয়সী ১২৪ জন। ২০১৯ সালে একই বয়সী নিহতের সংখ্যা ১০৩ জন।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকায় প্রায় শতাধিক কিশোর গ্যাং রয়েছে। এর মধ্যে সক্রিয় আছে ৩৪টি কিশোর গ্যাং।
এদিকে সম্প্রতি র্যাবের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ৫০টি কিশোর গ্যাং সক্রিয়। এর মধ্যে উত্তরায় সক্রিয় ২২টি ও মিরপুরে ১০টি। এছাড়া তেজগাঁও, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, হাজারীবাগ, মহাখালী, বংশাল, মুগদা, চকবাজার ও শ্যামপুরে একাধিক গ্যাং সক্রিয়। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা খুন, ছিনতাই-চাঁদাবাজি, শ্লীলতাহানি, ইভটিজিং ও মাদক ব্যবসার মতো অপরাধে বেশি জড়িয়ে পড়ছে।
র্যাব জানায়, ২০২০ সালে বিভিন্ন অপরাধে কিশোর গ্যাংয়ের ২০ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত বিভিন্ন অপরাধে কিশোর গ্যাংয়ের ৭১ জন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে চলতি বছরের ৭ জুন পর্যন্ত বিভিন্ন অপরাধে গ্রেফতার হয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের ৩৭৪ জন সদস্য।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) সূত্রে জানা গেছে, রমনা বিভাগে সাতটি কিশোর গ্যাং গ্রুপ রয়েছে। এসব গ্রুপের সদস্য ৬৯ জন। তাদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ১৪টি। লালবাগ বিভাগে ‘ইয়ামিন কিশোর গ্যাং’ গ্রুপে রয়েছে ১১ জন সদস্য। তাদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে পাঁচটি। ওয়ারীতে রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের ৬৯ জন সদস্য। তাদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ১৩টি। মতিঝিল বিভাগে রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সাতজন সদস্য। তাদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ছয়টি। তেজগাঁও বিভাগে রবিন গ্রুপে রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের আটজন সদস্য। তাদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে একটি। মিরপুর বিভাগে রবিন গ্রুপে রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের ১০ জন সদস্য। তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। গুলশান বিভাগে কিশোর গ্যাংয়ের একজন সদস্য রয়েছে। তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে তিনটি। উত্তরা বিভাগে বিগ বস গ্রুপে রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের ৫৫ জন সদস্য। তাদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে তিনটি।
র্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সাল থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ডিএমপিতে বিভিন্ন নামে ১১টি কিশোর গ্যাং গ্রুপের তালিকা করা হয়েছে। এগুলোর মোট সদস্য ২৩০ জন। তাদের বিরুদ্ধে মোট মামলা সংখ্যা ৪৫টি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিশোর-তরুণরা দেশের ভবিষ্যৎ। তাদের বিপথগামী হওয়ার আগেই সামাজিক আন্দোলন জরুরি। কিশোরদের অভিভাবকরাও রয়েছেন বেখেয়াল। সন্তান কোথায় সময় কাটায়, কী করে—তার কোনো খোঁজ তারা নেন না। সমাজের মুরব্বি শ্রেণিও তাদের ব্যাপারে উদাসীন। এছাড়া মোবাইল ফোন তথা প্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে তাদের অনেকে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে।
কিশোর গ্যাংয়ের কাছে দেশি অস্ত্রের ছড়াছড়ি। এমনকি অত্যাধুনিক বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্রও রয়েছে তাদের কাছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথ্য ও ছবি আদান-প্রদান করে পরস্পরকে হামলার নির্দেশ দেয় তারা।
সম্প্রতি মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে কিশোর গ্যাংয়ের ১১ সদস্যকে আটক করা হয়। আটককালে তাদের কাছ থেকে চাকু ও ছুরি উদ্ধার করা হয়েছে। এই গ্যাংটি রাজধানীর বিভিন্ন নির্জন এলাকায় পথচারীদের আটকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে টাকা, স্বর্ণালংকার, মোবাইল ফোন নিয়ে পালিয়ে যেত। শুধু চুরি-ছিনতাই নয়, ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ছে কিশোররা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরাধে জড়িত কিশোরদের বিরাট অংশ নিম্নবিত্ত পরিবারের। রাজধানীসহ দেশের ছোট-বড় শহরে দরিদ্র পরিবারের লাখ লাখ কিশোর বড় হয় অযতœ-অবহেলায়। তারা রেল স্টেশন, লঞ্চ-টার্মিনাল, অফিসের বারান্দা, এমনকি ফুটপাতে খোলা আকাশের নিচে জীবন কাটায়। নদীভাঙন ও নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের নির্মম শিকার দেশের বিভিন্ন এলাকার পরিবারের শিশু-কিশোরদের কোনো ‘আসল’ ঠিকানাও নেই।
তারা আরও বলছেন, দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত শিশু-কিশোররাই প্রথমে অপরাধ জগতের নবীন সদস্য হয়ে কালক্রমে শীর্ষস্থানে চলে যায়। শুধু নিম্ন বা মধ্যবিত্ত নয়, উচ্চবিত্ত পরিবারের কিশোরদেরও কখনো ভয়ঙ্কর অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। অর্থাভাব যেমন একটি কিশোরকে অপরাধ জগতে ঠেলে দিচ্ছে, তেমনি অর্থের প্রাচুর্যও কখনো অনর্থের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সেবন করছে দামি সিগারেট, গাঁজা, ইয়াবা, আইস, এমনকি এলএসডির (লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইইথ্যালামাইড) মতো ভয়াবহ মাদক। নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার নামে তারা নানা ধরনের অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়ছে।
গত ৫ জুন তেজগাঁওয়ে জাতীয় চলচিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের (এফডিসি) ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির আয়োজনে ‘কিশোর অপরাধ বৃদ্ধিতে সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার’ শীর্ষক ছায়া সংসদ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে র্যাব মহাপরিচালক (ডিজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, অপরাধ দমনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সক্ষমতা রয়েছে। ইতিবাচক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাসমূহ অপরাধ দমনে কাজ করছে। দেশে কিশোর গ্যাংয়ের অস্তিত্ব থাকবে না।
তিনি আরও বলেন, কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি অভিভাবক ও শিক্ষকসহ সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। বিশেষত পরিবারে সন্তানদের প্রতি বাবা-মায়ের নজরদারি বাড়াতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। সৃজনশীল কাজে সম্পৃক্তকরণের মাধ্যমে কিশোর অপরাধ হ্রাস করা সম্ভব।
পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদও কিশোর গ্যাং নিয়ে উৎকণ্ঠার কথা জানিয়েছেন। গত ১১ জানুয়ারি র্যাবের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে এখন বড় সমস্যা কিশোর গ্যাং। পরিবারকে জানতে হবে তার ছেলে বা মেয়ে কার সঙ্গে মেশে, কখন কী করে, কোথায় যায়; এটা প্যারেন্টাল কন্ট্রোল (পিতা-মাতার দায়িত্ব)। সন্তান জন্ম দিলে দায়-দায়িত্ব বাবা-মাকে নিতেই হবে। দায়িত্ব নেবেন না, তবে জন্ম দিয়েছেন কেন? এটি বাবা-মার সামাজিক, নৈতিক, ধর্মীয় দায়িত্বও বটে।’
নানা নামে কিশোর গ্যাং
পাওয়ার বয়েজ, ডিসকো বয়েস, বিগ বস, নাইন স্টার, নাইন এমএম বয়েস, এনএনএস, এফএইচবি, জিইউ, ক্যাকরা, ডিএইচবি, ব্ল্যাক রোজ, রনো, কে-নাইন, ফিফটিন গ্যাং, পোটলা বাবু, সুজনা ফাইটার, আলতাফ জিরো, ক্যাসল বয়েজ, ভাইপার, তুফান, থ্রি গোল, শাহীন-রিপন এবং নামিজ উদ্দিন গ্যাং, বিহারী রাসেল গ্যাং, বিচ্চু বাহিনী, পিচ্চি বাবু ও সাইফুল গ্যাং ইত্যাদি।
আগে খুন-ধর্ষণের মতো ঘটনায় বেশি জড়াতো কিশোররা। তবে সম্প্রতি পাচারের মতো অপরাধেও কিশোর গ্যাংয়ের জড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছে।টিকটক ভিডিও তৈরির ফাঁদে ফেলে তরুণীদের ভারতে পাচারের বিষয়টি সবার সামনে আসে।
ভারতে বাংলাদেশি এক তরুণীর যৌন নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হলে অনুসন্ধানে নামে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ওই তরুণীকে নির্যাতনের ঘটনায় রিফাদুল ইসলাম হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয় নামে ঢাকার মগবাজার এলাকার একজনকে শনাক্ত করে পুলিশ। পরে জানা যায়, হৃদয় মেয়েটিকে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানোর কথা বলে বছরখানেক আগে ভারতে নিয়ে যায়। শুধু ওই তরুণী নয়, আরও কয়েকজনকে ভারতে পাচার করেছে সে।
ভারতে বাংলাদেশি তরুণীকে যৌন নির্যাতনের ঘটনায় টিকটক হৃদয়সহ ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়
বাংলাদেশ পুলিশের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজের ইনবক্সে দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে চট্টগ্রাম থেকে কিশোর গ্যাংয়ের তিন সদস্যকে আটক করা হয়। এরপর পুলিশ জানায়, ওই চক্রটি বিভিন্ন সময় ভাড়ায় খাটে। টাকার বিনিময়ে অর্থদাতার বিপক্ষের ওপর আক্রমণ চালিয়ে থাকে তারা।
পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স) মো. সোহেল রানা জানান, চট্টগ্রাম থেকে গত ২৪ মে একজন সচেতন নাগরিক পুলিশের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজের ইনবক্সে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্যের একটি লিংক শেয়ার করেন। লিংকে সংযুক্ত ভিডিওতে দেখা যায়, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের পাঁচলাইশ থানাধীন মুরাদপুর ১নং রেললাইনের নিকটবর্তী এলাকায় কিছু উচ্ছৃঙ্খল কিশোর দেশীয় অস্ত্র-শস্ত্র হাতে আশপাশের দোকানপাটে ভাঙচুর ও মারপিট করছে।
ভিডিওর সঙ্গে সংযুক্ত টেক্সটে দাবি করা হয়, এটা একটি কিশোর গ্যাংয়ের কাজ। তারা অত্যন্ত বেপরোয়া। তারা দোকানে ছিনতাই করে, হকারদের সঙ্গে মারামারি করে। যখন-তখন যার-তার সঙ্গে মারামারিতে লিপ্ত হয়। আশঙ্কা করা হয়, যেকোনো সময় আরও বড় ধরনের দুর্ঘটনা, এমনকি মার্ডারের মতো ঘটনাও ঘটতে পারে।
দুই বছর লন্ডনে পড়াশোনা করেছেন রাজিব চৌধুরী বাপ্পি ওরফে লন্ডন বাপ্পি (৩৫)। এরপর দেশে ফিরে প্রতিষ্ঠা করেন কিশোর গ্যাং গ্রুপ ‘ডি কোম্পানি’ বা ‘ডেয়ারিং কোম্পানি’। তার গ্রুপে রয়েছে ৫০ জনের বেশি সদস্য। প্রত্যেকে সপ্তাহে তিনশ থেকে চারশ টাকা করে পেতো। এই সদস্যদের দিয়ে চাঁদাবাজি, ডাকাতি, মাদক বিক্রি ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন অপরাধ কার্যক্রম চালানো হতো।
লন্ডনে পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরে কিশোর গ্যাং গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন বাপ্পি
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, ২০১৩ সালে পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরে তিন বছর পর (২০১৬ সালে) ‘ডি কোম্পানি’ বা ডেয়ারিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন বাপ্পি। এর দু’বছর পর ফেসবুকে গ্রুপ বা মেসেঞ্জারে গ্রুপ খুলে অপরাধ কার্যক্রম শুরু হয়। বানানো হয় একটি ‘লোগো’। বাপ্পির গ্রুপে ৫০ জনের বেশি সদস্য রয়েছে। এ সদস্যদের প্রতি সপ্তাহে তিনশ থেকে চারশ টাকা করে দিতেন তিনি। প্রতি মাসে অটোরিকশা থেকে চাঁদাবাজি, মাদক, আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন মাধ্যমে কয়েক লাখ টাকা আদায় করতেন বাপ্পি।
তিনি বলেন, বর্তমান সময়ে কিশোর গ্যাং তথা গ্যাং কালচার এবং উঠতি বয়সী ছেলেদের মাঝে ক্ষমতা বিস্তারকে কেন্দ্র করে এক গ্রুপের সঙ্গে অন্য গ্রুপের মারামারি করা বহুল আলোচিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। গ্যাং সদস্যরা এলাকায় নিজেদের অস্তিত্ব জাহির করতে নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত করছেন। এ বিষয়ে সন্তানদের ওপর বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যদের নজরদারি রাখা খুর জরুরি। সন্তানরা কার সঙ্গে মেলামেশা করছে, ফেসবুক বা ইন্টারনেটে কোন কোন গ্রুপের সঙ্গে জড়িত সেসবের ওপর নজরদারি করা প্রয়োজন। নয়তো ছোটখাট বিষয় নিয়ে সাধারণ মানুষের ওপর চড়াও হয়ে খুনোখুনি করে কিশোর বয়সেই অপরাধী হয়ে উঠতে পারে কিশোররা।
কিশোর অপরাধ বলে কম গুরুত্ব দিয়ে দেখার সুযোগ নেই
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, কিশোর অপরাধ বলে কোনোভাবে কম গুরুত্ব দিয়ে দেখার সুযোগ নেই। কারণ, কিশোররা এখন প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন বা প্রযুক্তিগত অগ্রগতির কারণে বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। নিজ দেশের সামাজিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে কিশোররা উদাসীন। অনেক বিষয় তারা মানতে চায় না। এই যে মানতে চায় না, এই জায়গা থেকে তাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা বা নৈরাজ্য তৈরি করার একটা প্রবণতা তৈরি হয়। এই জায়গাগুলোতে আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের কার্যক্রম বাড়াতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে শিশুদের লালন-পালন করার ক্ষেত্রে পরিবারগুলো শিক্ষা, চিকিৎসা এবং অন্যান্য বিষয়ে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করছে না। নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরা অপরাধে জড়ায়, এমন একটি কথা সমাজে প্রচলিত আছে। এ ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এখন উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরাও অপরাধে জড়াচ্ছে। সঠিক ও সুষ্ঠু সামাজিকীকরণের বিষয়টি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না বলে কিশোরদের মধ্যে ক্ষোভ-হতাশা তৈরি হচ্ছে। এগুলো প্রশমিত না হওয়ায় তারা নানা ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছে। এসব কারণ বিশ্লেষণ করে সমাধানের কার্যকর উদ্যোগ না নিলে কিশোর অপরাধ কমানো সম্ভব নয়।