ইসরায়েলি গোয়েন্দারা কিভাবে ইরানে গোপন অভিযান চালায় তার বিশদ বিবরণ তুলে ধরেছেন দেশটির গোয়েন্দা বাহিনী মোসাদের সদ্য বিদায়ী প্রধান ইয়োসি কোহেন। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে ইরানের পরমাণু আর্কাইভে ঢুকে কীভাবে হাজার হাজার নথি বের করে নেওয়া হয়েছে, তার রোমহর্ষ বর্ণনা দিয়েছেন তিনি।
ইরানের নাতাঞ্জ পরমাণু স্থাপনা ধ্বংস এবং একজন পরমাণুবিজ্ঞানী হত্যায় ইসরায়েলের সম্পৃক্ততার ইঙ্গিতও দিয়েছেন ইয়োসি কোহেন।
শুক্রবার বিবিসির এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ইসরায়েলের চ্যানেল ১২–এর ইউভডা ডকুমেন্টারি প্রোগ্রামে সাংবাদিক ইলান ডায়ানকে ওই সাক্ষাৎকার দেন কোহেন। ওই ডকুমেন্টারি ইসরায়েলি টেলিভিশনে গত বৃহস্পতিবার রাতে সম্প্রচার হয়। সাক্ষাৎকারে মোসাদের কার্যক্রমের গোপন অনেক বিষয় সামনে এসেছে। কোহেন পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে মোসাদকে নেতৃত্ব দেওয়ার পর গত সপ্তাহে অবসরে যান।
২০১৮ সালে ইরানের ওয়্যারহাউসে হামলা চালিয়ে পরমাণু কর্মসূচিসংক্রান্ত হাজার হাজার নথি চুরি করে ইসরায়েলে নিয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন তিনি। ২০১৮ সালে নেতানিয়াহু এক সংবাদ সম্মেলনে চুরি করা ওই সব নথি দেখিয়ে দাবি করেছিলেন, ইরান গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে। ইরান বরাবরই এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
টাইমস অব ইসরায়েল জানায়, সাক্ষাৎকারে কোহেন বলেছেন- ‘ওই অপারেশন পরিকল্পনা করতে দুই বছর সময় লেগেছিল। এর সঙ্গে ২০ জন মোসাদ এজেন্ট মাঠপর্যায়ে যুক্ত ছিলেন। তবে এসব এজেন্টের কেউই ইসরায়েলের নাগরিক ছিলেন না। তেল আবিবের কমান্ড সেন্টার থেকে গোয়েন্দাপ্রধান ওই অপারেশন দেখছিলেন। এজেন্টরা ওয়্যারহাউস ভেঙে ঢুকে পড়ে ৩০টি সিন্দুক ভাঙেন। স্ক্রিনে যখন ওই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো দেখানো হয়, তা ছিল আমাদের জন্য দারুণ রোমাঞ্চকর।’
বিবিসির ওই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, মোসাদের সাবেক প্রধান হিসেবে গণমাধ্যমের সামনে বিশেষ কিছু বিষয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার ঘটনা একেবারে নতুন নয়। তবে ইয়োসি কোহেনের মন্তব্যে যে মাত্রায় বিস্তারিত তথ্য উঠে এসেছে, তা অসাধারণ।
এদিকে টাইমস অব ইসরায়েল এই সাক্ষাৎকারকে ‘বিস্ময়জাগানিয়া’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কোনো রোমাঞ্চধর্মী গল্পের মতোই কোহেন তাড়ার মুখে এজেন্টদের সিন্দুক ভেঙে ইরানের পারমাণবিক তথ্য বের করে আনার এবং তা দেশের বাইরে পাঠানোর ঘটনা বর্ণনা করেন।
অন্য আরেক জায়গায় ইরানের ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর বিষয়টি স্বীকার করার কাছাকাছি চলে আসেন। তবে ওই সাক্ষাৎকারটি যথেষ্ট হিসাব–নিকাশ করেই প্রচার করা হয়েছে। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর সেন্সরও পার হয়েছে। এ ছাড়া সাক্ষাৎকারটি প্রকাশের সময়টিও গুরুত্বপূর্ণ। পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে ছয় বিশ্বশক্তির সঙ্গে ইরানের সমঝোতা চুক্তি যখন নতুন করে জীবন পাওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে, সে সময় সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করা হলো।
ইরান থেকে হাজার হাজার নথি হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়টি খোলাখুলিই বলে আসছে ইসরায়েল। তবে কোহেন ইরানে মোসাদের অন্য অপারেশন সম্পর্কেও ইঙ্গিত দিয়েছেন, যা এত দিন গুঞ্জন হিসেবেই দেখা হতো। সাক্ষাৎকারের শুরুতেই কোহেন ইরানের নাতাঞ্জ পারমাণবিক স্থাপনা নিয়ে কথা বলেন।
ইরানের ভাষ্য, গত বছরের জুলাই মাসে তাদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ স্থাপনায় হামলার ঘটনায় অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এ বছরের এপ্রিল মাসে নতুন যন্ত্রপাতি স্থাপনের পরদিনই ইরানের কর্মকর্তারা সেখানে আবার হামলা ও বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির কথা জানান। ওই ঘটনায় ইরানের পক্ষ থেকে ইসরায়েলের প্রতি পারমাণবিক সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালানোর অভিযোগ করা হয়।
কোহেন তার সাক্ষাৎকারে আরও বলেন, তিনি ইরানের ওই স্থাপনা সম্পর্কে খুব ভালোভাবে জানেন। এমনকি তিনি ওই স্থাপনার ঘূর্ণমান সেন্ট্রিফিউজের কাছ পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারবেন। তিনি বলেন, ‘ইরান যে সেলার ব্যবহার করে সেটা ঘূর্ণমান। এখন অবশ্য এ ধরনের সেলার ব্যবহৃত হয় না।’
সাক্ষাৎকারে ইরানের পরমাণুবিজ্ঞানী মহসেন ফাখরিজাদেকে নিয়েও কথা বলেন কোহেন। গত বছরের নভেম্বরে তেহরানের বাইরে তার ওপর হামলা চালানো হয়। ওই ঘটনার জন্য সরাসরি ইসরায়েলকে দোষারোপ করে ইরান।
ওই বিজ্ঞানীর মৃত্যুর ঘটনায় ইসরায়েলের যুক্ত থাকার কথা স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটাই করেননি কোহেন। তবে তিনি বলেন, ওই বিজ্ঞানী দীর্ঘদিন ধরেই লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলন। কারণ, তার বৈজ্ঞানিক প্রজ্ঞা মোসাদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
কোহেন বলেন, ‘যদি কোনো ব্যক্তি ইসরায়েলের জনগণের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠেন, তবে তাকে বর্তমান কার্যক্রম থামাতে হবে। তবে কেউ যদি পেশা পরিবর্তন করে এবং আমাদের আর ক্ষতি না করেন, তবে তিনি বেঁচে যাবেন।’
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ২০১৫ সালে কোহেনকে মোসাদের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পর ১৯৮২ সালে মোসাদে যোগ দিয়েছিলেন কোহেন।