নাহিদা নিশি: ব্যক্তির মেজাজের পেছনে হরমোনের প্রভাব থাকলেও, কেউ সেটার ধার ধারে না। সমাজে প্রতিষ্ঠিত সত্য হলো, ‘পুরুষের মেজাজ হবে আক্রমণাত্মক, অন্যদিকে নারী হবে আবেগপ্রবণ, দুর্বল, কোমল’। কিন্তু সত্যি কি তাই?না, নারীর হৃদয় সবসময় কুসুম-কোমল না। নারী সবসময় নদীর মতো শান্ত না। ক্ষমতা পেলে, সুযোগ পেলে নারীও হয়ে উঠতে পারে হিংস্র, পুরুষের মতো আক্রমণাত্মক। ক্ষমতায়িত নারীরা হয়ে উঠতে পারে পিতৃতন্ত্রের সেবাদাসী, হতে পারে নারী নিপীড়ক।
গতো ৫০ বছরে অপরাধজগতে নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। অস্ত্র পাচার, নারী পাচার, মাদকব্যবসায় বিপুল সংখ্যক নারী জড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বব্যাপী সব ধরণের অপরাধকার্যে নারীর অংশগ্রহণ ১৮ শতাংশ কিংবা তারচেয়ে কিছু বেশি। পুরুষের তুলনায় নারী অপরাধীর সংখ্যা কম হওয়ার কারণ কী? তারা তুলনামূলক কোমল হৃদয়ের? উহু। এর পেছনে অন্যতম একটি কারণ সম্ভবত, পুরুষের সমান ক্ষমতা না থাকা। কার আচরণ ঠিক কতোটা আক্রমণাত্মক হবে, দুর্বলকে ঠিক কতোটা আঘাত করবে, সমস্ত কিছুই মূলত ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে।
‘ক্ষমতা’ বিষয়টাই পিতৃতান্ত্রিক। যার হাতে ক্ষমতা থাকে, সেই দুর্বলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজের অবস্থান জানান দিতে চায়। যার কারণে নিজেকে নারীবাদী দাবি করা নারীকেও আমরা দেখি গৃহকর্মী নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটাতে। নারী, পুরুষ এমনকি কোনো কোনো নারীবাদীও মনে মনে বিশ্বাস করে যে, নারীরা দুর্বল; নারীরা নিম্নশ্রেণির মানুষ!
একবিংশ শতাব্দীতে এসে ক্ষমতাহীন নারীদের অবস্থা অনেকটা ‘ক্রীতদাসের ক্রীতদাস’ এর মতো। তারা প্রথমত নারী হবার কারণে পুরুষ কর্তৃক, আবার ক্ষমতাহীন নারী হবার কারণে নারী ও পুরুষ উভয় কর্তৃক নির্যাতিত হয়।
শ্রমিক নির্যাতনের দিক থেকে পঞ্চম অবস্থানে আছে গৃহশ্রমিক নির্যাতন। গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে শিশু গৃহকর্মীদের ৮৩ শতাংশই মেয়েশিশু, যার ৬০ শতাংশ শারীরিক কিংবা মানসিক নির্যাতনের শিকার, যাদের বেশিরভাগই গৃহকর্ত্রী (কোনো নারী) কর্তৃক নির্যাতিত। নারী যদি প্রাকৃতিকভাবেই কোমল হৃদয়ের কিংবা মমতাময়ী হতো, তাহলে এই সংখ্যাটা নিশ্চয়ই এতো বড় হতো না।
কিছুদিন আগে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের গলা চেপে ধরেছিল মাকসুদা সুলতানা পলি নামের একজন নারী, কাজী জেবুন্নেসা নামক আরেক নারীর মদদে। এই ঘটনায় অনেকে বলেছেন পলিকে নারী হিসেবে না দেখে অপরাধী হিসেবে দেখতে, একইভাবে বলেছেন রোজিনা ইসলামের নারী পরিচয়কে সামনে না এনে তার সাংবাদিকতা পেশাকে প্রায়োরিটি দিতে। আমারও তাই মত। এই ঘটনায় রোজিনা ইসলাম পেশাগত কারণেই হিংস্রতার শিকার হয়েছিলেন, নারী হওয়ার কারণে না। রোজিনার জায়গায় কোনো পুরুষ হলেও হয়তো একই ঘটনা ঘটতো। কিন্তু রোজিনা ইসলাম যদি পুরুষ হতো, তাহলে কি পলি তার গায়ে হাত তুলতো? তুলতো না। সেক্ষেত্রে পলির জায়গায় হয়তো অন্য কোনো পুরুষ থাকতো। পলি কোনো পুরুষ সাংবাদিকের গলা চেপে ধরার সাহস করতো না। রোজিনার গলা চেপে ধরার সাহস করেছে, কারণ পুরুষের মতো পিতৃতান্ত্রিক নারীরাও নারীদের দুর্বল ভাবে, ডোমিনেট করার চেষ্টা করে।
গত ক’দিন ধরে স্যোশাল মিডিয়ায় একটি ভিডিও ঘুরছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে, চারজন পুরুষ ও একজন নারী মিলে একটি মেয়েকে উলঙ্গ করেনানাভাবে শারীরিক টর্চার করছে। যৌনাঙ্গে মদের বোতল ঢুকিয়ে দিচ্ছে। সেই দৃশ্য এমনই ভয়ঙ্কর যে, দেখার পর যেকোনো সুস্থ মানুষ অসুস্থ বোধ করবে। ঘুম হারাম হয়ে যাবে যেকোনো বিবেকবান মানুষের। ঘটনাটি ঘটেছে ভারতের কেরালায়। জানা গেছে অপরাধীরা এবং ভিক্টিম, সকলেই বাংলাদেশি। মেয়েটি নারী পাচারকারী একটি চক্রের ফাঁদে পড়েছে। ভিডিওটি দেখে অনেকেই অবাক হয়েছেন এই ভেবে যে, একজন নারীও সেখানে রয়েছে নির্যাতনকারী হিসেবে!
আমরা ধরেই নেই যে, একজন নারী কখনোই এভাবে আরেকজন নারীর ক্ষতি করতে পারে না। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে অন্যকিছু। বিশ্বের সমস্ত অপরাধে (চুরি, ডাকাতি, খুন) পুরুষের তুলনায় নারীর অংশগ্রহণ অতি নগণ্য হলেও জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী নারী পাচারের সাথে ৩৮ শতাংশ কিংবা তার চেয়ে বেশি নারী জড়িত রয়েছে। আরেকটি গবেষণা বলছে, মধ্য ইউরোপ এবং পূর্ব এশিয়ায় নারী পাচার ও ফোর্সড প্রস্টিটিউশনের পেছনে যাদের হাত রয়েছে, তাদের ৬৮ শতাংশই নারী। দেখা গেছে, নারী পাচারকারী নারীরা পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি নির্দয় ও হিংস্র হয়।
পাপিয়ার কথা মনে আছে? ১৭’শ নারী তার নিয়ন্ত্রণে ছিল। দেশ, বিদেশ, পাহাড়, সমতল থেকে শতশত নারী এনে তাদেরকে যৌনকর্মে বাধ্য করতেন পাপিয়া। এছাড়া গৃহবধূ নির্যাতনের ঘটনা তো আমাদের দেশে খুব সাধারণ। এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নির্যাতনকারীর ভূমিকায় প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে কোনো না কোনো নারীকে (শাশুড়ি, ননদ) পাওয়া যায়।
নারীর ক্ষমতায়ন বলতে প্রথম অবস্থায় নারীর আর্থিক, সামাজিক, শিক্ষাগত উন্নয়নকে বোঝালেও সত্যিকার অর্থে এসবের কোনো ভিত্তি নেই। একসময় লিবারেল ফেমিনিস্ট’রা মনে করতেন, নারী শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেলেই ধীরে ধীরে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের পতন ঘটবে। বাস্তবে সেটা হয়নি। বাংলাদেশে নারী শিক্ষার হার বর্তমানে প্রায় ৭১.২%, কিন্তু নারীর প্রকৃত মুক্তি ঘটেনি। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা নারীদের শেষপর্যন্ত পিতৃতন্ত্রের শিক্ষাই দেয়, যার কারণে দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, স্পীকার সকলে নারী হলেও নারী জাতির ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটে না। নারী নির্যাতনের হার কমে না। ধর্ষণের পরিমাণ কমে না।
নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে কেবল তাদের শ্রেণিগত উন্নয়নই ঘটে, পিতৃতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার চেহারা বদলায় না। বরং নারী আবির্ভূত হয় পিতৃতন্ত্রের প্রতিনিধিরূপে। পিতৃতান্ত্রিক পুরুষকে তাও পাশ কাটিয়ে যাওয়া যায়, কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক নারীদের এড়িয়ে যাওয়া কষ্টকর। এরা আরও বেশি ভয়াবহ হয়। বাইরে থেকে দেখে তাদেরকে নারীর ক্ষমতায়নের রোল মডেল মনে হলেও তারা মূলত নারীমুক্তির পথের কাঁটা।
বায়োলজিক্যালি পুরুষ হয়ে জন্মালেই যেমন সকলে বদমেজাজি কিংবা নিপীড়ক হয় না, তেমনি নারী হয়ে জন্মালেই কেউ নরম, কোমল কিংবা আবেগপ্রবণ হয় না। নারী মানেই মায়ের জাত না। নারী মানেই নারীর বন্ধু না। বরং নারী হতে পারে পিতৃতন্ত্রের রক্ষক, হতে পারে নারীবিদ্বেষী।
সূত্র- ফেমিনিস্ট ফ্যাকর