ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২১ই নভেম্বর ২০২৪ , বাংলা - 

নতুন মাদক এলএসডির সন্ধান বাড়াচ্ছে উদ্বেগ

2021-05-28, 12.00 AM
নতুন মাদক এলএসডির সন্ধান বাড়াচ্ছে উদ্বেগ

দীর্ঘদিন ধরে দেশে মাদকদ্রব্য ইয়াবার আগ্রাসন চলছেই। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অবস্থানের মধ্যেও ঠেকানো যাচ্ছেনা ইয়াবা।এর মধ্যে ভয়াবহ মাদক লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাই-ইথ্যালামাইডের (এলএসডি) সন্ধান নতুন করে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে অর্থাৎ পশ্চিমা বিশ্বে এই মাদক প্রচলনের কথা শোনা গেলেও বাংলাদেশে এটি একেবারেই নতুন। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) দেশে প্রথমবারের মতো এলএসডি উদ্ধারের কথা দাবি করেছে।

তবে আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, ভয়াবহ এই মাদকসহ যে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের একজন প্রায় এক বছর ধরে এলএসডির সঙ্গে পরিচিত। নিজে ব্যবহারের পাশাপাশি এলএসডি নিতে উদ্বুদ্ধ করেছেন বন্ধুদেরও। এরইমধ্যে বন্ধুরা মিলে ফেসবুকে গ্রুপ খুলে এলএসডি বিক্রির তথ্যও পাওয়া গেছে।  শনাক্ত হওয়া একটি ফেসবুক গ্রুপেই সদস্য সংখ্যা প্রায় এক হাজার।

ডিবি পুলিশের ধারণা, দামি ও দুষ্প্রাপ্যতার কারণে এলএসডি এখনো উচ্চবিত্ত তথা বিভিন্ন কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পর্যায়ের ক্রেতাতেই সীমাবদ্ধ। বিষয়টি এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত না হলেও অনুসন্ধান অব্যাহত রাখার কথা জানানো হয়েছে। তদন্তে সরবরাহ কিংবা ভোক্তা পর্যায়ে যাদেরই সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে তাকেই আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।

বুধবার (২৬ মে) রাতে রাজধানীর ধানমন্ডি ও লালমাটিয়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে এলএসডিসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে ডিবি রমনা বিভাগ। এসময় তাদের কাছ থেকে ২০০ ব্লট এলএসডি উদ্ধার করা হয়, যার মূল্য আনুমানিক ছয় লাখ টাকা।

গ্রেফতাররা হলেন- সাদমান সাকিব ওরফে রূপল (২৫), আসহাব ওয়াদুদ ওরফে সূর্য (২২) ও আদিব আশরাফ (২৩)। যারা প্রত্যেকেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

এলএসডি কি?
লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাই-ইথ্যালামাইড বা এলএসডি এক ধরনের তরল। সাধারণত ব্লটিং পেপারের উপর এই তরল মাদক ফেলে সেই কাগজ শুঁকে নেশা করেন মাদকাসক্তরা। এলএসডি মাখা কাগজের এক-একটি ছোট টুকরো বা ব্লটিং পেপারের দাম কয়েক হাজার টাকা। ডিবির হাতে গ্রেফতাররা জানান, প্রতিটি ব্লটিং পেপার তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি হতো।

১৯৩৮ সালে সুইস রসায়নবিদ আলবার্ট হফম্যান প্যারাসাইটিক ফাঙ্গাস নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এলএসডি আবিষ্কার করেন। আবিষ্কারের প্রথমদিকে এলএসডি ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হতো। তবে ওষুধটি মস্তিষ্কের ক্ষতি করে বলে পরে এটিকে নিষিদ্ধ করা হয়।

এই মাদক এতটাই শক্তিশালী যে ডোজগুলো মাইক্রোগ্রাম পরিমাণে নিতে হয়। এটি গন্ধহীন, বর্ণহীন এবং কিছুটা তেঁতো স্বাদের হয়। আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অন ড্রাগ অ্যাবিউজ (এনআইডিএ) এর তথ্যানুযায়ী, এলএসডি আমেরিকায় নিষিদ্ধ। এর কোনো মেডিক্যাল ব্যবহার নেই, অর্থাৎ নেশাদ্রব্য হিসেবেই এটি তৈরি হয়।

ভারতীয় তরুণ অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর পর এই মাদক নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। তার বিরুদ্ধে এই মাদক নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। এছাড়া, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অতিমাত্রায় ক্ষতিকর এই মাদক এলএসডি গ্রহণের তথ্য পাওয়া যায়।

এলএসডির প্রতিক্রিয়া
বিজ্ঞানীরা জানান, সাধারণত এলএসডি নেওয়ার পর একজন মানুষ চোখ বন্ধ করেও দেখতে পায়। তার দেখা এসব দৃশ্য সব সময় বাইরের পৃথিবী বা স্মৃতি থেকে আসে না বরং তাদের কল্পনাশক্তি অনেক বেড়ে যায়। এলএসডির প্রভাবে মস্তিষ্কের অন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।

তারা বলেন, এলএসডি নেওয়ার পর প্রকৃতি ও বাইরের জগতের সঙ্গে এমন এক সম্পর্ক অনুভূত হয় যাকে অনেকটা ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক রূপ দেওয়া হয়। এই মাদকের প্রভাব কেটে গেলেও ওই রকম অনুভূতি থেকে যেতে পারে।

এলএসডি ব্যবহার করলে মানুষের স্মৃতির ভাণ্ডার খুলে যায়। শোনা যায়, নেশার চূড়ান্ত পর্যায়ে কেউ কেউ মাতৃগর্ভের স্মৃতিও মনে করতে পারেন। তবে সেসব স্মৃতির ভার অধিকাংশ মানুষই সহ্য করতে পারেন না। ফলে মস্তিষ্ক বিকৃতির প্রবল সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া অধিকাংশ মাদকগ্রহণকারীই স্মৃতির চূড়ান্ত স্তরে প্রবেশের আগে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তবে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলছেন, হ্যালুসিনেশনই এসব অনুভূতির মূল কারণ।

গ্রেফতারদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, এটি ব্যবহার করলে যে কারো মাথা ভার হয়ে যাবে, হ্যালোজেনিক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। কেউ যদি গান শোনে তার সামনে গানের নোটগুলো বিভিন্ন রঙের মতো ঘুরতে থাকে।

সেবনকারী অত্যন্ত হিংসাত্মক ও আক্রমণাত্মক আচরণ করে, নিজেকে অনেক শক্তিশালী ভাবে। প্রচণ্ড উত্তেজনার সঙ্গে চিন্তা, অনুভূতি এবং পারিপার্শ্বিক চেতনাকে পরিবর্তন করে দেয়। একটি এলএসডি ব্লট সেবনে ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত এর প্রতিক্রিয়া থাকে। অতিরিক্ত সেবনে ২০ ঘণ্টা পর্যন্তও প্রতিক্রিয়া থাকতে পারে।

যেভাবে সন্ধান মিললো এলএসডির
সম্প্রতি ডাববিক্রেতার দা দিয়ে নিজ গলায় আঘাত করে হাফিজুর রহমান নামে এক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা তদন্তে ভয়াবহ মাদক এলএসডির সন্ধান পায় ডিবি। হাফিজের বন্ধুদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ঢাবির আইবিএর বহিষ্কৃত ছাত্র সাদমানকে ধানমন্ডি থেকে আটক করা হয়। তিনি বর্তমানে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ (ফাইনাল) অধ্যায়ণরত আছেন। যিনি নিজে এলএসডি সেবন করেন এবং বন্ধুসহ পরিচিতদের মধ্যে সরবরাহ করতেন।

তবে আত্মহত্যা করা ঢাবির ওই শিক্ষার্থীর মাদক এলএসডি গ্রহণের বিষয়টি এখনো নিশ্চিত নয়। তার কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে এই এই মাদকের তথ্য পাওয়া গেলেও তার এলএসডি গ্রহণের বিষয়টি নিশ্চত হতে মেডিক্যাল রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করতে হবে বলে জানায় ডিবি।

যেভাবে দেশে আসে এলএসডি
ডিবি জানায়, গ্রেফতারদের মধ্যে সাদমান সাকিব ওরফে রূপল মূলহোতা। তিনিই কুরিয়ারের মাধ্যমে নেদারল্যান্ড থেকে এলএসডি আনান। ডাক টিকিটের মতো দেখতে ৮০০-১০০০ টাকায় প্রতিটি ব্লট কেনেন তিনি। এক নেদারল্যান্ড নাগরিকের সঙ্গে টেলিগ্রাম অ্যাপসে যোগাযোগ করে 'পেপালের' মাধ্যমে মাদকের টাকা পাঠাতেন।

এলএসডির ক্রেতা
প্রাথমিকভাবে ধনী-সম্ভ্রান্ত পরিরিবারের সন্তানরাই এই মাদকের ক্রেতা বলে জানা যায়। এটি ব্যাপক আকারে সর্বত্র এখনো ছড়ায়নি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সাদমানকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে ডিবি জানায়, 'আপনার আব্বা' নামে তার একটি ফেসবুক আইডি রয়েছে। তিনি ''Better brawry and beyound' ' নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ পরিচালনা করেন, যেখানে প্রায় এক হাজার সদস্য রয়েছে। সাদমান, আসহাব ও আদিব এই তিনজন মিলে ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে এলএসডি বিক্রি করতেন।

বিক্রি করতেন গাঁজার কেক
এলএসডি বিক্রির পাশাপাশি গ্রেফতাররা নতুন একটি নিজস্ব নেশাজাত পণ্যও চাহিদামতো সরবরাহ করতেন। তারা গাঁজা পাতার নির্যাস দিয়ে কেক তৈরি করে ওই ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে বিক্রি করতেন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এলএসডি দেশের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮-এর ‘খ’ শ্রেণিভুক্ত মাদক, যা নিষিদ্ধ। ২০১৯ সালে মহাখালী ডিওএইচএস থেকে কানাডা প্রবাসী এক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে এলএসডি উদ্ধার হয়েছিল। সর্বশেষ ডিবি পুলিশের হাতে এই মাদক উদ্ধারের পর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সব অফিসকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।

ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, এলএসডি এখনো ব্যাপকভাবে ছড়ায়নি। এটি যেহেতু দেশে একেবারেই নতুন তাই আমরা এটির চাহিদা বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি। গ্রেফতারদের ফেসবুক গ্রুপটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে, যাদেরই এই মাদকের সঙ্গে যে কোনোভাবে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ছোট স্ট্যাম্পের মতো এলএসডি ব্লট কুরিয়ারে আসে বলে এটি দেশে প্রবেশ ঠেকানো অনেকটা কষ্টসাধ্য। আমরা চাহিদা বন্ধের জায়গায় কাজ করছি। এছাড়া, যারা নেদারল্যান্ড থেকে এই মাদকটি বাংলাদেশে পাঠাতো, তাদের শনাক্তের জন্য পুলিশ সদরদপ্তরের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হবে।