প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে আমরা যেমন সর্বাত্মক ব্যবস্থা নিয়েছি, তেমনি আক্রান্তদের চিকিৎসায় সর্বোচ্চ উদ্যোগ নিয়েছি। ইতোমধ্যে আমরা চিকিৎসা সক্ষমতা অনেকগুণ বৃদ্ধি করেছি।বৃহস্পতিবার (১৩ মে) পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী একথা বলেন।প্রধানমন্ত্রী বলেন, সবচেয়ে কার্যকর এবং পরীক্ষিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা’র টিকা দিয়েই আমরা গণটিকাকরণ কার্যক্রম শুরু করেছি। আপনারা জেনেছেন, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ টিকা রপ্তানির ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ফলে সরবরাহ ব্যবস্থায় কিছুটা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এমতাবস্থায়, আমরা বিকল্প উৎস থেকে টিকা সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছি।
ইতোমধ্যে রাশিয়া এবং চিনের টিকা উৎপাদনকারী সংস্থার সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে। উপহার হিসেবে চীনের কাছ থেকে টিকা ইতোমধ্যেই আমরা পেয়েছি। আমরা টিকা পাওয়ার জন্য আমেরিকার কাছেও অনুরোধ জানিয়েছি। বিশ্ব টিকাকরণ সংস্থা কোভ্যাক্সের কাছ থেকেও আমরা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ টিকা পাবো। বিভিন্ন উৎস থেকে আমরা এক কোটি টিকা ক্রয়ের ব্যবস্থা নিয়েছি। খুব শিগগিরই দেশে টিকা আসতে শুরু করবে। তাছাড়া, দেশেই যাতে টিকা উৎপাদন করতে পারি সে ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি। নিজেদের টিকা তৈরিতে কয়েক মাস সময় লাগবে। আমরা দেশের সকল নাগরিককে টিকার আওতায় নিয়ে আসবো।
তিনি বলেন, ডাক্তার, নার্স, অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীসহ কয়েকটি পেশার কর্মীগণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সামনে থেকে কোভিড-১৯ রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। আবার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যগণ এবং কেন্দ্রীয় ও মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাবৃন্দ লকডাউন বা চলাচলের বিধিনিষেধ বলবৎ করতে মাঠে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। ত্রাণসামগ্রী বিতরণসহ সরকারের নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। সংবাদকর্মীগণ সংক্রমনের ঝুঁকি উপেক্ষা করে সংবাদ পরিবেশনের কাজ করে যাচ্ছেন। সবাইকে আমি আন্তরিক ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে বহু স্বাস্থ্যকর্মী, আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্য এবং বিভিন্ন সংস্থার কর্মকতা-কর্মচারি প্রাণ হারিয়েছেন। এছাড়া, গত এক বছরে আমরা আমাদের অনেক প্রিয়জনকে হারিয়েছি। আমি সকলের রুহের মাগফিরাত ও আত্মার শান্তি কামনা করছি। শোক-সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে আমরা যেমন সর্বাত্মক ব্যবস্থা নিয়েছি, তেমনি আক্রান্তদের চিকিৎসায় সর্বোচ্চ উদ্যোগ নিয়েছি। ইতোমধ্যে আমরা চিকিৎসা সক্ষমতা অনেকগুণ বৃদ্ধি করেছি। সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হাসপাতালকেও আমরা করোনাভাইরাস চিকিৎসায় সম্পৃক্ত করেছি। গত মাসে মহাখালী ডিএনসিসি মার্কেটে ২ হাজার শয্যার কোভিড-১৯ হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছে। গত বছর মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ৬ হাজার ১৬৬ জন ডাক্তার, ৫ হাজার ৫৪ জন নার্স এবং প্রায় সাড়ে ৪ হাজার অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। জেলা হাসপাতালগুলোসহ দেশের ১৩০টি সরকারি হাসপাতালে কেন্দ্রিয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।
সরকার প্রধান বলেন, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। এই ভাইরাসের সংক্রমন ঠেকাতে মাস্কের ব্যবহার অত্যন্ত ফলপ্রসু বলে প্রমাণিত হয়েছে। কাজেই বাইরে গেলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করবেন। পাশাপাশি যথাসম্ভব ঘনঘন সাবানপানি দিয়ে হাত ধুইয়ে নিন অথবা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত জীবানুমুক্ত করুন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। সেই সাথে সাথে আপনারা নিজেরা গরম পানির ভাপ নিতে পারেন।
দেশবাসী উদ্দেশ্যে বলেন, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস শুধু মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে না, এই ভাইরাস বিশ্ব অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। সংক্রমণ এড়াতে লক-ডাউন বা সাধারণ ছুটি বলবৎ করতে হয়েছে। আমরা গত বছর একটানা দুই মাসেরও বেশি সাধারণ ছুটি বলবৎ করেছিলাম। দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানার পর গত মাসের ৫ তারিখ থেকে পর্যায়ক্রমে লক-ডাউন কার্যকর করা হয়েছে। এরফলে অগণিত মানুষের রুটি-রুজির উপর আঘাত এসেছে। কিন্তু এই কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা ছাড়া বিকল্প কোন উপায় ছিল না। কারণ, আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, প্রতিটি দেশেরই স্বাস্থ্য অবকাঠামোর একটি নির্দিষ্ট সক্ষমতা রয়েছে। হঠাৎ করে দ্রুতগতিতে রোগী বাড়তে থাকলে তখন সেবা দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। আপনারা দেখেছেন, উন্নত দেশগুলো পর্যন্ত করোনা রোগীর সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। সেজন্য আমাদের কোনোভাবেই রোগীর সংখ্যা বাড়তে দেওয়া যাবে না। তবে আমরা জীবন ও জীবিকার মধ্যে একটা সামঞ্জস্য বজায় রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি। যাঁরা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, তাঁদের সহায়তার জন্য সরকার সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা সরকার গৃহিত পদক্ষেপ তুলে ধরে বলেন, গত বছর করোনাভাইরাস আঘাত হানার পর থেকে চলতি মাস পর্যন্ত সর্বমোট এক লাখ ঊনত্রিশ হাজার ছয়শত তের কোটি টাকার সহায়তা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। এরমধ্যে প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ২১টি খাতে সর্বমোট ১ লাখ ২১ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আর অনুদান বাবদ ৮ হাজার ২৬০ কোটিরও বেশি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। গত বছর সাময়িক কর্মহীন ৩৬ লাখ ৫০ হাজার মানুষকে আড়াই হাজার টাকা করে মোট ৯১২ কোটি ৫০ লাখ দেওয়া হয়েছে। এ বছরও সমসংখ্যক মানুষকে একই হারে ৯১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া ত্রাণ মন্ত্রণালয় ৬০৭ কোটি টাকা বিতরণ করেছে। দিনমজুর, পরিবহন শ্রমিক, সাধারণ শ্রমিক, নি¤œআয়ের মানুষ, মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী, মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন, অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সেবকগণ, বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষক - ইত্যাদি পেশার মানুষজন এ সহায়তা কর্মসূচির আওতায় এসেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুজিববর্ষ উপলক্ষে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় ১ম পর্যায়ে ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে ৬৫,৬৫৪ টি ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে ৫৩,৪৩৪ টি গৃহ নির্মাণের কাজ চলছে। এ নিয়ে মোট গৃহের সংখ্যা দাঁড়াবে ১ লাখ ১৯ হাজার ৮৮। বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় এ পর্যন্ত আমরা সাড়ে তিন লাখ পরিবারকে গৃহ নির্মাণ করে দিয়েছি।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি প্রসঙ্গে বলেন, করোসাভাইরাস মহামারির সময়েও সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতাধীন বিভিন্ন ভাতা, খাদ্য কর্মসূচি, শিক্ষার্থীদের বৃত্তি-উপবৃত্তি প্রদানসহ আমরা সকল ধরনের সরকারি সহায়তা কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছি। এসব কর্মসূচির সুবিধাভোগী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি ৭৮ লাখ। এরমধ্যে বিভিন্ন ভাতাভোগীর সংখ্যা ১ কোটি ৭ লাখ, খাদ্য নিরাপত্তার আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা ২ কোটি ১৮ লাখ এবং বৃত্তি-উপবৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২ কোটি ৫৩ লাখ।
তিনি আরো বলেন, জনগণের সহযোগিতায় এবং আমাদের সরকারের সময়োচিত কার্যক্রম গ্রহণের ফলে আমরা বিগত এক বছর করোনাভাইরাস মহামারিজনিত আর্থিক অভিঘাত খুব ভালোভাবেই সামাল দিতে পেরেছি। আমরা যখন প্রথম ঢেউ সামলিয়ে অর্থনীতিকে সাবেক অবস্থার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসার পর্যায়ে, তখনই মার্চ মাসে দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হেনেছে। এতে করে আমাদের প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধিতে হয়তো খানিকটা ভাটা পড়বে। তবে আমাদের অভ্যন্তরীণ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার হিসেবে এবারও আমরা আশানুরূপ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হবো। গত সপ্তাহে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছে।
তিনি বলেন, ঈদের দিন আনন্দের দিন। মনের সব কালিমা দূর করে, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে একে অপরের সঙ্গে মিলিয়ে যাওয়ার মধ্যেই ঈদের আনন্দ। আজকের দিনে আমরা হিংসা-বিদ্বেষ, ঘৃণা, লোভ, অহমিকা, ক্রোধ, অহঙ্কার ইত্যাদি যাবতীয় কুপ্রবৃত্তি থেকে নিজেদের মুক্ত করে সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, ঐক্য, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার শপথ নেবো।