চক্রব্যূহে আটকে পড়েছেন নরেন্দ্র মোদি। বিখ্যাত মেডিকেল জার্নাল দ্য ল্যানসেট সম্পাকদীয় প্রতিবেদনে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে কাঠগড়ায় তুলল। তারা লিখেছে, ‘জাতীয় বিপর্যয় ডেকে আনার জন্য মোদিই দায়ী। সংকটের সময় তিনি যা করেছেন তাতে মনে হয়েছে, কোভিডের মোকাবিলার চেয়ে টুইটারের সমালোচনা মুছতে তাঁর ব্যগ্রতা বেশি। এই স্বকীয় অপরাধ অমার্জনীয়।’ সাত বছরে এমন নাস্তানাবুদ মোদিকে কখনো হতে হয়নি। এই সংকট তাঁরই কৃতকর্মের ফল। নিজের বিচার-বুদ্ধি-বিবেচনা এবং অনুগত আমলাশাহির বদান্যতায় তিনি একা হাতে এত দিন সংকটের মোকাবিলা যেভাবে করেছেন, কোভিডকালে তা বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে। সর্বস্তরীয় সমালোচনায় কিংকর্তব্যবিমূঢ়তায় ভোগা প্রধানমন্ত্রী দল ও সরকারকে যে বিপজ্জনক অবস্থানে নিয়ে এসেছেন, সেখানে তিনি শুধু সঙ্গীহীনই নন, বিরুদ্ধ কাতারে দাঁড়িয়ে পড়েছে অন্য সবাই। মায় একদা তাঁরই অনুগত পরামর্শদাতাসহ দেশের সর্বোচ্চ আদালতও।
বিজ্ঞাপন
কথায় বলে, বিপদ যখন আসে, সব দিক থেকে আসে। নরেন্দ্র মোদির বিপদ শুধু কোভিডবাহিতই নয়, অর্থনীতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রেও। এই ত্রিফলা আক্রমণের মুখে আপাতত তিনি অসহায়। সেই অবসরে বিপুলভাবে সক্রিয় বিরোধীকুল, সুপ্রিম কোর্ট, একসময়কার অনুগত পরামর্শদাতা এবং বৈশ্বিক সংবাদমাধ্যম। দিন দিন তাঁর উজ্জ্বল ভাবমূর্তি জৌলুশ হারাচ্ছে। মোদি সরকারের প্রতি সর্বস্তরীয় আস্থা এখন এতটাই তলানিতে যে অক্সিজেন সংকট কাটাতে সুপ্রিম কোর্ট শনিবার ১২ বিশেষজ্ঞের একটি টাস্কফোর্স গঠন করতে বাধ্য হয়েছেন। এ সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি অনাস্থারই নামান্তর।
এ জন্য নিজেকে ছাড়া প্রধানমন্ত্রী আর কাউকেই দায়ী করতে পারবেন না। জানুয়ারির শেষে দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের অধিবেশনে (ভার্চ্যুয়াল) অংশ নিয়ে তিনি করোনার বিরুদ্ধে ভারতের জয়ী হওয়ার কৃতিত্ব দাবি করেছিলেন। বিশ্বের তাবৎ বিশেষজ্ঞের আশঙ্কাকে ‘ভুল’ প্রতিপন্ন করে বলেছিলেন, ‘করোনার বিরুদ্ধে লড়াইকে জন–আন্দোলনে পরিণত করে ভারত সফল হয়েছে।’ গর্বের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘যে দেশে পৃথিবীর ১৮ শতাংশ মানুষের বসবাস, তারা শুধু নিজেকেই নয়, গোটা বিশ্বকে এই বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছে।’ তিন মাসের মধ্যে সেই গর্বের বেলুন শুধু চুপসেই গেল না, পরিত্রাণের জন্য মোদির ভারত আজ বিশ্বের কৃপাপ্রার্থী। দ্য ল্যানসেট–এর আশঙ্কা, ১ আগস্টের মধ্যে ভারতে কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যা ১০ লাখ ছোঁবে।
লাগামছাড়া সংক্রমণ ও মৃত্যু ত্রাহি ত্রাহি রবই শুধু নয়, প্রধানমন্ত্রীকে নিদারুণ উপহাসের পাত্রও করে তুলেছে। মহারাষ্ট্রের শিবসেনাও বলতে ছাড়ছে না, ‘মোদির ভারত এতটাই আত্মনির্ভর যে বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কাকেও আজ সাহায্যের হাত বাড়াতে হচ্ছে!’ কংগ্রেসের গুণগান করে শিবসেনার মুখপত্র সামনা লিখেছে, ‘৭০ বছর ধরে নেহরু-গান্ধীর দল যে ব্যবস্থা তৈরি করে গেছে, দেশ বেঁচে রয়েছে তারই দৌলতে।’
এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি, বিপর্যয়ের মেঘ যখন ছাইতে শুরু করে, দেশের মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ যখন টিকার প্রথম ডোজ পেয়েছেন, মোদি সরকার তখন তিনটি সিদ্ধান্তের কথা জানায়। ১ মে থেকে সব প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি টিকা পাবে। প্রস্তুতকারকেরা খোলাবাজারে টিকা বিক্রি করতে পারবে এবং কারা কোন দামে টিকা পাবে, সেই দাম প্রস্তুতকারক নিজেরাই নির্ধারণ করবে। এখান থেকেই বিতর্ক শুরু। কারণ, কেন্দ্রীয় সরকার আর একমাত্র টিকার ক্রেতা থাকল না। রাজ্যগুলোর জন্য ধার্য দাম হলো কেন্দ্রের চেয়ে বেশি। বেসরকারি সংস্থার জন্য আরও বেশি। দামের এই তারতম্যে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত প্রশ্ন তোলেন, কোন যুক্তিতে ত্রিস্তরীয় দাম ধার্য হলো এবং কেনই–বা বেসরকারি হাসপাতাল দুটি ডোজের জন্য ২ হাজার ৪০০ রুপি আদায় করবে। সরকারকে সুপ্রিম কোর্ট বুঝিয়ে দেন, এই সিদ্ধান্তের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন অবধারিত।
আচ্ছে দিনের বুদ্বুদ মিলিয়ে লাশের আগুন ও কাফনের হাহাকারে আকাশ-বাতাস এখন ভারী। কে বলতে পারে, এত দিন উড়তে থাকা নরেন্দ্র মোদি চক্রব্যূহে আটকে পড়ে ধুলোমলিন বেশে নিয়তির মুখোমুখি হতে চলেছেন কি না? তা যদি ঘটে, নিজেকে ছাড়া আর কাউকে তিনি দোষের ভাগী করতে পারবেন না
বিজ্ঞাপন
সুপ্রিম কোর্টে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মামলা দামের এই তারতম্যকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েই অতিমারির সময় দেশের নাগরিকদের বিনা মূল্যে টিকা পাওয়ার অধিকারের প্রশ্ন তুলে রাজ্য সরকারের দাবি, টিকার দাম সবার জন্য ১৫০ রুপি বেঁধে দেওয়া হোক। দেশের অন্যান্য রাজ্যও পশ্চিমবঙ্গের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে কি না, সময়ই তা বলবে।
বিরোধী রাজনৈতিক দল ও সরকারই নয়, মোদির টিকা নীতির সমালোচনায় মুখর একদা তাঁরই ঘনিষ্ঠ সহযোগীরাও। নীতি আয়োগের প্রথম প্রধান হিসেবে মোদি যাঁকে বেছেছিলেন সেই অরবিন্দ পানাগড়িয়া বলেছেন, ‘টিকার বিকেন্দ্রীকরণ এক বিরাট ভুল।’ টিকা নীতির সমালোচনা করেছেন মোদির সাবেক প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মানিয়ানও। তিনি বলেছেন, ‘তিনটি বিষয়ে নজর দেওয়া দরকার। টিকার দাম বেঁধে দেওয়া যাতে অযথা অনিশ্চয়তা সৃষ্টি না হয়, সেই দাম শূন্য হওয়া উচিত, যাতে সবাই তা পেতে পারে এবং উৎপাদককে টিকার দাম মেটানোর দায় কেন্দ্রের, রাজ্যের নয়।’ প্রধানমন্ত্রী মোদির অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পর্ষদের সাবেক সদস্য ভি অনন্ত নাগেশ্বরন বলেছেন, ‘কেন্দ্র, রাজ্য ও বেসরকারি সংস্থার জন্য তিন ধরনের টিকার দামে অব্যবস্থা ও বিভ্রান্তি চূড়ান্ত হবে।’ তাঁর মতে, ‘টিকার বড়জোর দুটি দাম হতে পারে। একটি কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের জন্য, অন্যটি বেসরকারি ক্ষেত্রে।’ টিকা নীতি দেখে মোদির অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পর্ষদের আরেক সাবেক সদস্য রথীন রায় হতাশা চেপে রাখতে পারেননি। তাঁর টুইট, ‘হায়, অবশেষে কেন্দ্রও হাত তুলে দিল!’
করোনাবাহিত এই বিপদের পাশাপাশি মোদি-শাহ জুটির এযাবৎ নির্মেঘ আকাশে ছেয়েছে রাজনৈতিক হতাশাও। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে জোড়া ধাক্কায় বিজেপিকে অবশ করেছে উত্তর প্রদেশ। তার ঠিক আগেই হতাশ করেছে কর্ণাটক পুরসভার ভোট। স্বশাসিত সেই রাজ্যের ১০টি বড় শহরের মধ্যে বিজেপির প্রাপ্য মাত্র ১টি। ছয়টি দখল করেছে কংগ্রেস, ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠে। উত্তর প্রদেশের পঞ্চায়েত ভোটে ১ নম্বরে সমাজবাদী পার্টি। জেলা পরিষদের মোট ৩ হাজার আসনের মধ্যে বিজেপির পাওনা এক–চতুর্থাংশ। মাত্র সাত মাস বাকি উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব ও উত্তরাখন্ড বিধানসভার ভোটের। কৃষক আন্দোলন ও করোনায় লেজেগোবর হওয়া বিজেপি তিন রাজ্যেই প্রমাদ গুনছে।
ভারতীয় গণতন্ত্রে প্রতিটি নির্বাচনই পৃথক। প্রতি ভোটেই নতুন চালচিত্র আঁকা হয়। তবু রাজনৈতিক নজরদারেরা সমকালীন পরিস্থিতির আলোয় অদূর ভবিষ্যৎকে দেখতে পছন্দ করেন। সাত মাস পরের উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব ও উত্তরাখন্ডের ভোট নিয়ে বিজেপিবিরোধী শক্তি করোনা, কৃষক আন্দোলন ও অর্থনৈতিক অভিঘাতের দরুন উৎসাহিত বোধ করছে। কে জানে মোদি-শাহ জুটির পক্ষে তা ভয়াবহ হয়ে উঠবে না? সাত মাস সময় মোটেই বেশি নয় এবং কোভিডের তৃতীয় তরঙ্গের আভাস যখন প্রবল।
আচ্ছে দিনের বুদ্বুদ মিলিয়ে লাশের আগুন ও কাফনের হাহাকারে আকাশ-বাতাস এখন ভারী। কে বলতে পারে, এত দিন উড়তে থাকা নরেন্দ্র মোদি চক্রব্যূহে আটকে পড়ে ধুলোমলিন বেশে নিয়তির মুখোমুখি হতে চলেছেন কি না? তা যদি ঘটে, নিজেকে ছাড়া আর কাউকে তিনি দোষের ভাগী করতে পারবেন না। ● সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি