ভোটের মাত্র ৯ মাস বাকি। এখনও নিজ নিজ অবস্থানে অনড় বড় দুই রাজনৈতিক দল। অন্যদিকে বিশিষ্টজন থেকে শুরু করে সব পক্ষের দাবি সমঝোতার। প্রধান নির্বাচন কমিশনারও বলছেন, দলগুলোর মধ্যে বোঝাপড়া না হলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অসম্ভব। দিন দিন রাজনৈতিক সংকট ঘণীভূত হচ্ছে। শঙ্কা তৈরি হচ্ছে রাজনৈতিক অস্থিরতার। এ নিয়ে সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্যোগ চোখে পড়ে না।গত ১৩ মার্চ কাতার সফরপরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে সরকারপ্রধান ও আওয়ামী লীগ সভাপতি সংলাপ বা আলোচনার বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেন, ‘কার সঙ্গে সংলাপ করবো? আপনারা পারবেন বাবা-মা ভাইয়ের খুনিদের সঙ্গে সংলাপ করতে? তারপরও দেশের স্বার্থে তাদের সঙ্গে সৌজন্য রক্ষা করতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু তারা সে পথ রুদ্ধ করেছে। খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে মারা যাওয়ার পর সান্ত্বনা দিতে গিয়েছি, দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।...তার এই বক্তব্যের পর রাজনৈতিক মহলে সংলাপ-সমঝোতার বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাব ছড়িয়েছে। বলা হচ্ছে, ‘বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগ সংলাপে বসবে না।’’যদিও আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, বিএনপির নীতি-নির্ধারকদের সাথে নানা বিষয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়েছে। একটি সুন্দর ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে।বিএনপি বলছে, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের চাবি সরাসরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে। তিনি যদি মনে করেন, দেশটাকে সহিংসতা থেকে বা রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে রক্ষা করবেন। তাহলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করবেন।এ নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বরাবরই বলে আসছেন, ‘আমরা চাই একটি শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করতে। সব বড় রাজনৈতিক দল যেন সেখানে অংশগ্রহণ করে সেটাও প্রত্যাশা করি। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঠিক বোঝাপড়া থাকতে হবে। আমরা সব বড় রাজনৈতিক দলকে অনুরোধ করছি, কোনো ফাঁক-ফোকর থাকলে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করতে হবে, যাতে সবাই নির্বাচনে অংশ নেয়।’সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারও একই মত দিয়েছেন। তিনি বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে বড় বড় রাজনৈতিক দলকেই আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় আসতে হবে। সংকট সমাধানে সমঝোতার বিকল্প নেই।এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলেন, ‘নির্বাচন দেশের সংবিধান অনুযায়ী হবে। এর ব্যত্যয় ঘটার সুযোগ নেই। তবে বর্তমানে যে নির্বাচনী পদ্ধতি আছে, এর ওপর কোনো ইমপ্রুভ করার থাকলে বিএনপি বা সমমনা দলগুলোর উচিত হবে নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে সেটা উপস্থাপন করা। তখন সরকার সেটা বিবেচনা করবে।’জাতীয় সংসদের হুইপ ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, বিএনপি জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। তাদের নীতি নির্ধারকদের সাথে নানা বিষয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়েছে। একটি সুন্দর ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে। সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সব দল লেভেল প্লেয়িং ময়দানে ভোট যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে।’এ বিষয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, ‘অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের চাবি হলো সরকারের হাতে। সরকারও নয়, সরাসরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে। তিনি যদি মনে করেন, দেশটা সহিংসতা থেকে বা রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে রক্ষা করবেন- তাহলে তিনি নিজে পদত্যাগ করে, সংসদ ভেঙে দিয়ে, তত্ত্বাবধায়ক বা অন্য কোনো নামে সরকার গঠন করে নির্বাচন দেবেন। এতেই নির্বাচন কমিশনের প্রত্যাশিত বা জাতির প্রত্যাশিত সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। আমাদের দেশের সংবিধান অনুযায়ীই তত্ত্বাবধায়ক বা ভিন্ন নামে সরকার দিয়ে নির্বাচন দেওয়া সম্ভব। চলমান সরকারের অধীনে নির্বাচন না করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়টি তিনিই (শেখ হাসিনা) তো আন্দোলন করে আনছেন। নির্বাচনী পরিবেশ বা প্রস্তুতির সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। তবে আবারও যদি তিনি ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন করতে চান তাহলে জনগণ বা অন্য দলগুলো তো সেটা মেনে নেবে না। তখন যদি প্রতিরোধ তৈরি করে, তাহলে দেশের অবস্থা কী দাঁড়াবে? আমি কি দেশটাকে রাজনৈতিক সহিংসতার দিকে ঠেলে দেব, নাকি দেশে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে সুন্দর পরিবেশ তৈরি করবো? এটা নির্ভর করে তার (শেখ হাসিনা) নিজের ইচ্ছার ওপর।’তিনি বলেন, ‘এটাতে আমাদেরও দায় আছে। আমরা বিভিন্ন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে জনগণের একটা চাপ তার ওপর রাখতেছি। এভাবে নির্বাচন করলে হবে না, বা আমরা যাবো না। এই চাপ আরও তীব্রতর করতে হবে। এই চাপটা যদি আরও তীব্রতর করতে পারি, মানুষের চাপ যদি আরও বাড়ে, তাহলে একটা সমাধান হবে। না হলে আমরা একটা সহিংসতার দিকে চলে যাচ্ছি, এটা কত ভয়ানক ও ক্ষতিকর হবে আল্লাহ জানে।’বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নাল আবদিন ফারুক বলেন, ‘বিএনপির একটাই কথা এই সরকারের অধীনে অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না। কারচুপি, ভোট ডাকাতি, লুট, ব্যালট ছিনতাই, রাহাজানির মধ্যেই নিজের লোক জেতানোর সব কৌশল অবলম্বন করে বিধায় ২০১৪ সালের নির্বাচনে আমরা যাইনি। ২০১৮’র নির্বাচনে গিয়ে ২০১৪ সালের মতো তাদের স্বৈরাচারী মনোভাব আরেকবার প্রমাণিত হয়। এখন জাতীয়তাবাদী দল ও জনগণের সিদ্ধান্ত- এ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাওয়া ঠিক হবে না। অতীতের মতোই তারা কলাকৌশল করে আবারও নির্বাচনে জয়লাভ করবে। সে কারণে এ সরকারের অধীনস্থ ইসিকেও আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা আন্দোলনে আছি, থাকবো। এই সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত কোনো নির্বাচনে যাবো না।’