পুরান ঢাকার চাঁনখারপুল ও কাপ্তানবাজারে দুটি বহুতল মার্কেট তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। ২০১৭ সালের শেষ দিকে শুরু হয়ে দুই বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা নির্মাণকাজ। সে অনুযায়ী দোকান বরাদ্দ দিয়ে পুরো টাকা নিয়ে নেওয়া হয়। কাজ দেওয়া হয় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে। এরপর পাঁচ বছর পার হলেও দোকান বুঝে পাওয়া দূরের কথা, বেজমেন্টের কাজও শেষ হয়নি। এত টাকা বিনিয়োগ করে বিপাকে পড়েছেন দোকান বরাদ্দ পাওয়া ব্যবসায়ীরা।নির্মাণকাজে এমন ধীরগতির কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এই দুটি মার্কেটে দোকান বরাদ্দ পাওয়া ব্যবসায়ীরা। তাদের অভিযোগ, এই দুটি মার্কেটে দোকান বরাদ্দ দিয়ে প্রায় শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে তো দূরের কথা, অতিরিক্ত তিন বছরেও নির্মাণকাজ শেষ করতে পারেননি ডিএসসিসির ঠিকাদার। বছরের পর বছর মার্কেট দুটির নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকেও চাপ দিচ্ছে না ডিএসসিসি।
তবে ডিএসসিসির প্রকৌশল বিভাগের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মার্কেট দুটি নির্মাণে যে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তারা কাজে গাফিলতি করেছে। এজন্য বাতিল করা হয়েছে তাদের কার্যাদেশ। নতুন করে ঠিকাদার নিয়োগে কাজ চলছে। কিন্তু ঠিক কবে ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হবে বা নির্মাণকাজ শুরু হবে তা সুনির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারেননি।
চাঁনখারপুল মার্কেট
ডিএসসিসির প্রকৌশল বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে চাঁনখারপুল মার্কেট নির্মাণের উদ্যোগ নেয় ডিএসসিসি। নকশা অনুযায়ী ১২ তলা ভিত্তির ওপর ছয় তলা ভবন হবে। ২৮১টি দোকান থাকবে। প্রতিটি দোকানের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে আয়তনভেদে ১১ থেকে ১২ লাখ টাকা। তখন মার্কেটটির নির্মাণব্যয় ধরা হয় ২৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। পরে ২০১৭ সালের দিকে ভবনটি নির্মাণের দায়িত্ব পায় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ‘দ্য বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েট লিমিটেড’।
এই প্রতিষ্ঠানের কার্যাদেশ অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ২ অক্টোবর এই মার্কেটের কাজ শুরু হয়। ২০১৯ সালের ১ অক্টোবরের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা। এরই মধ্যে চার কিস্তিতে গ্রহীতাদের কাছ থেকে ২৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকা তুলে নিয়েছে ডিএসসিসি। আর ঠিকাদারও করপোরেশন থেকে বিল তুলেছে ১৩ কোটি টাকা। কিন্তু তারা তুলে নেওয়া বিলের সমপরিমাণ কাজ করেনি বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
রোববার (১৬ অক্টোবর) সরেজমিনে দেখা যায়, চাঁনখারপুল মার্কেটের চারপাশে টিন দিয়ে ঘেরা। কিন্তু ভেতরে কোনো নির্মাণশ্রমিক বা সামগ্রী নেই। মার্কেটটির বেজমেন্টে বৃষ্টির পানি জমে আছে। সেখানে জন্মাচ্ছে মশার লার্ভা। মার্কেটটির কোথাও কোনো সাইনবোর্ড নেই। সিটি করপোরেশনেরও কোনো দিকনির্দেশনা দেখা যায়নি।
এই মার্কেটের চতুর্থ তলায় লটারিতে দোকান বরাদ্দ পান হোসেনি দালানের হাবিবুর মোল্লা। আলাপকালে তিনি বলেন, বাড়ির পাশে মার্কেট হচ্ছে দেখে ডিএসসিসিতে দোকানের জন্য আবেদন করি। যথাযথভাবে দোকানও বরাদ্দ পেয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত মার্কেটটির নির্মাণকাজ শুরু হয়নি। অথচ প্রায় ১২ হাজার টাকা বর্গফুট হিসেবে দোকানের দাম নেওয়া হয়েছে। এতে ১০০ বর্গফুট দোকানের জন্য দিতে হয়েছে প্রায় ১২ লাখ টাকা।
চকবাজারে একটি ভাড়া দোকানে কাপড়ের ব্যবসা করেন গাজীপুরের বাহার উদ্দিন। তিনিও চাঁনখারপুল মার্কেটের তৃতীয় তলায় একটি দোকান বরাদ্দ পেয়েছেন। আলাপকালে তিনি বলেন, মার্কেটটির নির্মাণকাজ বন্ধ থাকলেও বরাদ্দ বাবদ সব টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ডিএসসিসি। কিন্তু তারা নির্মাণকাজ করছে না। এটা করপোরেশনের তামাসা ছাড়া আর কিছুই নয়।
এই মার্কেটটি ডিএসসিসির অঞ্চল-৩ এর আওতাধীন। জানতে চাইলে অঞ্চল-৩ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মফিজুর রহমান বলেন, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে চাঁনখারপুল মার্কেটটি নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তারা সঠিকভাবে মার্কেটটির নির্মাণকাজ করেনি। কিন্তু বিল উঠিয়ে নিয়েছে ১৩ কোটি টাকা। তাই ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের নির্দেশে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কার্যাদেশ বাতিল করা হয়েছে। এখন নতুন করে ঠিকাদার নিয়োগে কাজ চলছে।
কাপ্তানবাজার মার্কেট
ডিএসসিসির রাজস্ব বিভাগ সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে কাপ্তানবাজার এলাকায় একটি মার্কেট নির্মাণে আগ্রহী ব্যক্তিদের কাছ থেকে আবেদন নেওয়া হয়। পরের বছর লটারির মাধ্যমে ওই মার্কেটে ৮৪২ জনকে দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়। এরপর চার কিস্তিতে এসব ব্যক্তির কাছ থেকে নেওয়া হয় ২৩ কোটি টাকা। ৮৪২ জনের মধ্যে ৯৯ শতাংশ গ্রহীতা টাকা জমা দিয়েছেন। তাদের সাময়িক বরাদ্দপত্রও দেওয়া হয়েছে।
তবে বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন পর্যন্ত মার্কেটের বেজমেন্টের নির্মাণকাজই শেষ হয়নি। ১৬ অক্টোবর সরেজমিনে দেখা যায়, কাপ্তানবাজার এলাকায় নির্মাণাধীন মার্কেট ভবনটির কেবল খুঁটি বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। সেখানে জমে আছে পানি। মশার প্রজননের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ! টিনের প্রাচীর জরাজীর্ণ। চাইলে যে কেউ ভেতরে প্রবেশ করতে পারে।
এই মার্কেটে ৫০ বর্গফুটের একটি দোকান পেতে সাড়ে চার বছর আগে ডিএসসিসির তহবিলে চার লাখ টাকা দিয়েছিলেন পুরান ঢাকার সারোয়ার হোসেন। দুই থেকে আড়াই বছরের মধ্যে দোকান বুঝে পাওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু এখন পর্যন্ত দোকান না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছেন তিনি। আলাপকালে সারোয়ার হোসেন বলেন, আমরা গরিব মানুষ, দোকান পেলে কিছু করে খেতে পারতাম। কবে দোকান পাবো, তা কেউ বলতে পারছে না।
সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগ সূত্র জানায়, বেজমেন্টসহ দোতলা ভবন নির্মাণে দ্য বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ার অ্যাসোসিয়েট লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দিয়েছিল ডিএসসিসি। ভবনটি নির্মাণের জন্য বরাদ্দ রাখা হয় প্রায় ৩০ কোটি টাকা। ২০২০ সালের মার্চ মাসের মধ্যে ভবনের নির্মাণকাজ শেষ করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে মাত্র ২০ শতাংশ কাজ শেষ হয়। এর বিনিময়ে করপোরেশন থেকে ৫ কোটি ২২ লাখ টাকা বিলও তুলে নিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট এক প্রকৌশলী বলেন, বর্তমান মেয়র দায়িত্ব নেওয়ার পর এই কাজ শেষ করতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কয়েক দফা তাগাদা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কাজে গতি না ফেরায় এই কার্যাদেশ চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে বাতিল করা হয়েছে। ভবনের বাকি কাজ শেষ করতে নতুন ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন।
ডিএসসিসির প্রধান প্রকৌশলী সালেহ আহম্মেদ বলেন, যে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে চাঁনখারপুল ও কাপ্তানবাজার মুরগি মার্কেট নির্মাণের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছিল, তারা যথাসময়ে কাজ শেষ করেনি। কাজ শেষ করতে তাদের বারবার তাগাদা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। তাই তাদের কার্যাদেশ বাতিল করা হয়েছে। জামানত জব্দ করে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। নভেম্বরের শুরুতে এই দুটি মার্কেটের জন্য পুনরায় দরপত্র আহ্বান করা হবে। সে অনুযায়ী প্রকৌশল দপ্তর কাজ করছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ বলেন, আইনি কিছু বিধি-নিষেধের কারণে এই দুটি মার্কেটে নতুন ঠিকাদার নিয়োগে দেরি হচ্ছে। আশাকরি শিগগির এই বিধি-নিষেধ কেটে যাবে।