ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২৮ই মার্চ ২০২৪ , বাংলা - 

এক ধরনের প্রতারণা করছে আলিশা মার্ট

ষ্টাফ রিপোর্টার

2021-07-14, 12.00 AM
এক ধরনের প্রতারণা করছে আলিশা মার্ট

আলেশা মার্ট ছয় মাস বয়সী এই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটি এ পর্যন্ত যত পণ্যই বিক্রি করেছে তার সবকটিতেই ছিল লোভনীয় ও আকর্ষণীয় অফার। সব পণ্যই তারা বিক্রি করেছে বাজারমূল্যের চেয়ে কম দামে। তাহলে লাভ করছে কীভাবে?

আলেশা মার্ট দুই মডেলের মোটরসাইকেল ৩৫ শতাংশ ছাড়ে বিক্রি করছে । তাদের এই অফারে ব্যাপক সাড়াও পড়েছে। এরই মধ্যে ৪৬ হাজার বাইকের জন্য ৬৫৮ কোটি টাকা দিয়েছেন গ্রাহকরা, যেগুলো সরবরাহ শুরুর তারিখ ছিল গত ৬ জুলাই।

তবে বুধবার এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কেউ বাইকও পায়নি। এ জন্য করোনাভাইরাসের দোহাই দিচ্ছে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটি।

আলেশা মার্টের এই যুক্তিতে সন্তুষ্ট নন গ্রাহকরা। তারা বলছেন, করোনার মধ্যেই যাত্রা শুরু করে লোভনীয় অফার দিয়ে আসছে আলেশা মার্ট। টাকা নিয়ে ৪৫ দিনের মধ্যেই মোটরসাইকেল বুঝিয়ে দেয়ার কথা ছিল তাদের। কিন্তু এখন করোনারই দোহাই দিচ্ছে; মোটরসাইকেল দিচ্ছে না। বিষয়টা তাদের জন্য উদ্বেগের। এটা এক ধরনের প্রতারণা বলেও মনে করছেন অনেকে।

অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, গ্রাহকরা যে ৪৬ হাজার মোটরসাইকেল অর্ডার দিয়েছেন, এর মধ্যে ২৮ হাজার ভারতের ১৫০ সিসির ডাবল ডিস্কের বাজাজ ব্র্যান্ডের পালসার আর ১৮ হাজার জাপানের ইয়ামাহা ব্র্যান্ডের ভার্সন-৩ বিএস-৬ মডেলের।

৩৫ শতাংশ ছাড়ের অফার অনুযায়ী আলেশা মার্ট প্রতিটি পালসার বাইকের জন্য গ্রাহকের কাছ থেকে ১ লাখ ১৮ হাজার টাকা নেয়। এ হিসাবে গ্রাহকরা জমা দিয়েছেন ৩৩০ কোটি ৪০ লাখ (১,১৮,০০০ গুণ ২৮ হাজার গ্রাহক) টাকা।

আর ইয়ামাহার ভার্সন-৩ বাইকের জন্য দিয়েছেন ১ লাখ ৮২ হাজার টাকা করে। এ হিসাবে বাইকটির জন্য আলেশা মার্টের কাছে গ্রাহকদের ৩২৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা আছে। সব মিলিয়ে শুধু এই ৪৬ হাজার মোটরসাইকেলের অর্ডার বাবদই গ্রাহকদের ৬৫৮ কোটি টাকা আছে নতুন এই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কাছে।

কাস্টমস কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশে এখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানি করে মোটরসাইকেল অ্যাসেম্বল করা হয়। এসব যন্ত্রাংশ আনতে সব মিলে কর দিতে হয় ৫৮ শতাংশ। আর প্রস্তুতকৃত বাইক আনতে কর দিতে হয় ১৫০ শতাংশ।

এ ক্ষেত্রে ১ লাখ টাকার একটা মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশ ৫৮ শতাংশ করে এনে সেটি প্রস্তুত করতে খরচ পড়ে ১ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। আর প্রস্তুতকৃত মোটরসাইকেলে ১৫০ শতাংশ করের হিসাবে খরচ পড়ে আড়াই লাখ টাকা। বর্তমানে বাংলাদেশে কিছু যন্ত্রাংশ তৈরি হওয়ায় অ্যাসেম্বল করা মোটরসাইকেলে মোট খরচ একটু কম পড়ে।

বাংলাদেশে ভারতের বাজাজের মোটরসাইকেল আমদানিকারক ও পরিবেশক উত্তরা মোটরস। আর এসকে ট্রেডার্স তাদের কাছ থেকে পাইকারিতে মোটরসাইকেল কেনে। এই এসকে ট্রেডার্সের সঙ্গেই পালসার মডেলের বাইক কেনার চুক্তি করেছে আলেশা মার্ট।

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটি বলছে, তারা বাজাজের পালসারে বাজারমূল্যের ওপর ৩৫ শতাংশ ছাড় দিয়ে ১ লাখ ১৮ হাজার টাকায় বিক্রি করছে। তারা এসকে ট্রেডার্সের কাছ থেকে এই বাইক কিনেছে ১ লাখ ১২ হাজার টাকা দরে।

তবে এসকে ট্রেডার্স বলছে, তারা নিজেরাই তৃতীয় পক্ষের কাছ থেকে পাইকারিতে কিনে বিক্রি করে এসব মোটরসাইকেল। আলেশা মার্টকে তারা ১ লাখ ১২ হাজার টাকা দরে বাইক দেয়নি; মিথ্যা বলছে আলেশা মার্ট। এই বাইকের খুচরামূল্য ১ লাখ ৮০ হাজার ৯০০ টাকা। আলেশা মার্টকে তারা কিছু টাকা ছাড় দেয় পাইকারি ক্রেতা হিসেবে। এর বাইরে আর কিছু নেই।

ভারতের ১৫০ সিসির ডাবল ডিস্কের বাজাজ ব্র্যান্ডের পালসার বাংলাদেশে আনতে কত খরচ পড়ে তা জানতে কথা হয় আমদানিকারক ও পরিবেশক উত্তরা মোটরসের সঙ্গে।

মতিউর রহমান নামে তাদের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এই পালসার বাইকের দাম ভারতে ৯৯ হাজার সামথিং। বর্তমানে আরও বেড়েছে। বাংলাদেশে এই বাইক আনতে এই দামের সঙ্গে ৪৫ শতাংশ ভ্যাট-ট্যাক্স যোগ হয়। সে ক্ষেত্রে বাইকটি বাংলাদেশে আনতে খরচ হয় ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা।’

উত্তরা মোটরসের এই কর্মকর্তার হিসাবের সঙ্গে কাস্টমস কর্মকর্তাদের হিসাবে ‘গরমিল’ থাকলেও তার হিসাব ধরেই কথা বলেছে আলেশা মার্টের কতৃপক্ষের সঙ্গে।

সাধারণত ১৫০ সিসির একটি পালসার বাইক আমদানি করতেই ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা পড়লে আলেশা মার্ট ১ লাখ ১৮ হাজার টাকায় গ্রাহককে কীভাবে দিচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা পালসার বাইকের জন্য গ্রাহক থেকে নিচ্ছি ১ লাখ ১৮ হাজার টাকা। এই বাইক কেনা পড়ে ১ লাখ ১২ হাজার টাকা।’

আলেশা মার্টের কতৃপক্ষের এমন বক্তব্যের পর আরও কয়েকজন পাইকারি ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হয়। তাদের ভাষ্য, ১ লাখ ১২ হাজার টাকায় ১৫০ সিসির পালসার বাইক বৈধ উপায়ে বাংলাদেশে কোনোভাবেই নিয়ে আসা সম্ভব নয়। ভারত থেকেই ১ লাখ টাকায় কিনতে হয় এই মোটরসাইকেল। তারপর আছে ভ্যাট-ট্যাক্স; আছে পরিবহন ও শোরুম খরচ।

এসব খরচ মিটিয়ে অফিশিয়াল খুচরা বাজারমূল্য ১ লাখ ৮০ হাজার ৯০০ টাকায় বিক্রি করতে হয় প্রতিটি ১৫০ সিসির পালসার। এতে মোটামুটি লাভ থাকে, যে লাভের টাকায়ই চলে প্রতিষ্ঠান।

আমদানিকারক ও পরিবেশক উত্তরা মোটরসের হিসাবেই মোটরসাইকেলের আমদানি খরচ ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। আর তাদের গ্রাহক এসকে ট্রেডার্স বলছে, এই মোটরসাইকেলের খুচরা মূল্য ১ লাখ ৮০ হাজার ৯০০ টাকা। এই এসকে ট্রেডার্সের কাছ থেকেই পাইকারিতে মোটরসাইকেল কিনে ৩৫ শতাংশ ছাড় দিচ্ছে আলেশা মার্ট।

তাই প্রশ্ন উঠেছে, খুচরার চেয়ে ৬২ হাজার টাকা কমে (৩৫% ছাড়ে) এবং পাইকারির চেয়ে ২৭ হাজার টাকা কমে বিক্রি করে দৃশ্যত লোকসান দিয়ে কীভাবে ব্যবসা চালাচ্ছে আলোচিত এই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। এমন লোভনীয় অফার দিয়ে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করার পেছনে আলেশা মার্টের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না, সে প্রশ্নও দেখা দিয়েছে জনমনে।

 

৪৬ হাজার বাইকে দৃশ্যত কত লোকসান?

আলেশা মার্ট প্রতিটি ১৫০ সিসির পালসার বাইকে পাইকারি দামের চেয়ে ২৭ হাজার টাকা এবং খুচরার চেয়ে ৬২ হাজার টাকা কম নিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পাইকারি হিসাব ধরলে ২৮ হাজার বাইকের জন্য ৭৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা এবং খুচরা হিসাব ধরলে ১৭৬ কোটি ১২ লাখ টাকা লোকসান করছে।

বাংলাদেশে ১৫০ সিসির ইয়ামাহার ভার্সন-৩ ব্র্যান্ডের একটি মোটরসাইকেলের খুচরা মূল্য ২ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। জাপানের এই বাইক ৩৫ শতাংশ ‘ডিসকাউন্ট অফারে’ ১ লাখ ৮২ হাজার টাকায় দিচ্ছে আলেশা মার্ট। খুচরা মূল্যের চেয়ে ৯৭ হাজার টাকা কমে বিক্রি করলে আলেশা মার্ট ১৮ হাজার বাইকে দৃশ্যত লোকসান করছে ১৭৪ কোটি ৬০ লাখ (১৮০০০ গুণ ৯৭০০০) টাকা।

এক পণ্যে লোকসান করলেও পুষিয়ে নিতে পারি

খুচরার এই হিসাবে দুই ব্র্যান্ডের ৪৬ হাজার মোটরসাইকেলের ওপর ৩৫ শতাংশ ছাড় দেয়ায় ৪৫ দিনে আলেশা মার্টকে লোকসান গুনতে হচ্ছে ৩৫০ কোটি ৭২ লাখ টাকা (১৭৬ কোটি ১২ লাখ ও ১৭৪ কোটি ৬০ লাখ)।

দুই ব্র্যান্ডের ৪৬ হাজার মোটরসাইকেলেই ৩৫০ কোটি টাকার বেশি লোকসান দিতে হলে ব্যবসা চলছে কীভাবে জানতে চাইলে আলেশা মার্টের কতৃপক্ষ বলেন, ‘আমরা এক পণ্যে লোকসান করলেও অন্যান্য পণ্য দিয়ে পুষিয়ে নিতে পারি।’

অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, ছয় মাস বয়সী এই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটি এ পর্যন্ত যত পণ্যই বিক্রি করেছে তার সবকটিতেই ছিল লোভনীয় ও আকর্ষণীয় অফার। সব পণ্যই তারা বিক্রি করেছে বাজারমূল্যের চেয়ে কম দামে। তাহলে লাভ করছে কীভাবে?

সম্প্রতি এক ফেসবুক পোস্টে তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘আলেশা মার্টে চলছে বিশাল ডিসকাউন্ট অফার। এখনই ডাউলোড করুন আমাদের মোবাইল অ্যাপ!’

পোস্টে বলা হয়, বিভিন্ন মডেলের মোটরসাইকেল, জামাকাপড়, ইলেকট্রনিকস ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে ৫ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিচ্ছে আলেশা মার্ট।

 

এর মধ্যে যেন বাজিমাত করেছে ভারতের ১৫০ সিসির ডাবল ডিস্কের বাজাজ ব্র্যান্ডের পালসার ও একই সিসির জাপানের ইয়ামাহা ব্র্যান্ডের ভার্সন-৩ বিএস-৬ মডেলের মোটরসাইকেলের অফার।

পরিশোধিত মূলধন ২০ লাখ টাকা!

নিবন্ধনের সময় আলেশা মার্ট পরিশোধিত মূলধন দেখিয়েছে ২০ লাখ টাকা আর অনুমোদিত মূলধন ২ কোটি টাকা।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধন নিয়ে যাত্রা শুরুর পর আলেশা মার্ট এ পর্যন্ত যত পণ্য বিক্রি করেছে ও বিক্রির প্রচার চালিয়েছে, তার সব কটিতেই ছিল নানা ধরনের ছাড়।

এমন পরিস্থিতিতে যদি দুই ব্র্যান্ডের ৪৬ হাজার মোটরসাইকেলেই দৃশ্যত ৩৫০ কোটি টাকার বেশি লোকসান দিতে হয়, ওই সব পণ্যে আরও কত লোকসান দেয়া হয়েছে বা দিতে হচ্ছে? আবার মাসের পর মাস লোকসান দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি চলছেই বা কী করে?

এসব প্রশ্নে প্রতিষ্ঠানটির কতৃপক্ষের সাথে কথা বলে জানাযায়, ‘২০ লাখ টাকা যে পরিশোধিত মূলধন, সেটা মূলত ভুলে করা হয়। আসলে এত কম টাকা করতে চায়নি। তাদের লোকজন ওই সময় ভুল করেছে। তবে তারা এখন পরিশোধিত মূলধন বাড়িয়েছি।’

গ্রাহকরা জানেনআলেশা মার্ট অন্যএকটি গ্রুপের

অনুসন্ধান করে জানাযায়,, আলেশা মার্টের বেশির ভাগ গ্রাহক জানেন, এটি দেশের অন্যতম ব্যবসায়িক গ্রুপ শিকদার গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। এ জন্যই নাকি আলেশা মার্টের ওপর বেশি আস্থা গ্রাহকদের।

এ বিষয়ে বেশ কয়েক জন গ্রাহকের বক্তব্য জানাযায়, এত বড় গ্রুপের প্রতিষ্ঠান আলেশা মার্ট অন্তত টাকা মারবে না। এই বিশ্বাসে টাকা জমা দিয়েছে তারা।

ওই ২০ গ্রাহকের একজন হোসেন। তিনি বলেন, ‘বাজারদরের চেয়ে অনেক কম টাকায় পণ্য পাচ্ছেন। প্রতারণার কথা মাথায় আসেনি?’

এক প্রশ্নের জাবাবে তিনি বলেন, ‘বাজারদরের চেয়ে কম টাকায় বাইক দিচ্ছে বলেই তো অর্ডার দিয়েছি। শুধু আমি না, হাজার হাজার লোক অর্ডার দিচ্ছে। তা ছাড়া তাদের রিভিউও ভালো দেখলাম।

‘আরেকটি বিষয় হলো, শুনছি আলেশা মার্ট নাকি শিকদার গ্রুপের। শুধু আমি না, আমার সঙ্গে যারা অর্ডার দিয়েছে। তারা সবাই জানে আলেশা মার্ট শিকদার গ্রুপের।’

প্রতারণা করতে আগে ভালো সাজতে হয়

অন্য একজন  গ্রাহক বলেন, ‘শুনছি আগে যারা বাইক অর্ডার করেছিল আলেশা মার্টে, তাদের অনেককেই বাইক দিছে। কিন্তু আমাদের বাইক ডেলিভারি ডেট অলরেডি পার হয়ে গেছে, আমরা কেউ এখনো বাইক পাইনি।’

এর কারণ কী হতে পারে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানে দুটি বিষয় আছে। প্রথমত আলেশা মার্ট বলছে, করোনার কারণে তাদের শোরুম খোলা নেই, সে জন্য তারা বাইক ডেলিভারি দিতে পারছে না। দ্বিতীয় বিষয়টা হচ্ছে, জুলাই মাসের ৬ থেকে ১৪ তারিখ পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজার বাইক ডেলিভারি দেয়ার কথা। এ অ্যামাউন্টটা কিন্তু অনেক বড়।

‘আমার মনে হচ্ছে, এত বড় অঙ্কের বাইক তারা অর্ডার পাইছে। টাকাও নিয়ে নিয়েছে। এত বাইক আসলেই ডেলিভারি দেবে কি না, কে জানে। কারণ প্রথম প্রথম সবাই ভালো থাকে, পরে প্রতারণা করে। কারণ প্রতারণা করতে আগে সবার চোখে ভালো হতে হয়।’

আলেশা মার্ট এভাবে কোনো প্রতারণা করতে চাইলে তা সরকারের দেখা উচিত বলে মনে করেন এই গ্রাহক।

৪৬ হাজার মোটরবাইকের জন্য টাকা নিয়েও গ্রাহকদের তা সরবরাহ না করার বিষয়ে জানতে চাইলে আলেশা মার্টের এক বড় কর্মকর্তা বলেন, ‘সব বাইকই রেডি। করোনার কারণে শোরুম খোলা যাচ্ছে না। তাই সময়মতো বাইকগুলো দিতে পারছি না।’

আলেশা মার্টচাটুকারিতা

অভিযোগ আছে, লোভের ফাঁদে ফেলে গ্রাহকদের কোটি কোটি টাকা নিজের কবজায় রেখে ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে আলেশা মার্ট। প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা ওই টাকা নিয়ে পালিয়ে যেতে পারেন। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আলেশা মার্ট-এক কর্মকর্তার কথায় চাটুকারিতা ধরা পরে।

তিনি বলেন, ‘আমাদের পারিবারিক অবস্থার খোঁজ নিয়ে দেখেন। আমি উত্তরাধিকার সূত্রেই অনেক সম্পত্তির মালিক। আমার পেইড আপ ক্যাপিটাল ২০ লাখ বা যা-ই হোক, মানুষের টাকা নিয়ে ফেরত দেয়ার ক্যাপাসিটি আমাদের আছে।’

আলেশা মার্ট শিকদার গ্রুপের কি না, সে বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির ঐ কর্মকর্তা বলেন, ‘অনেকে হয়তো জানে আলেশা মার্ট শিকদার গ্রুপের। অনেকে কমেন্টও করে।

‘কিন্তু শিকদার গ্রুপের সঙ্গে আলেশার কোনো সম্পর্ক নেই। দুটি ভিন্ন জিনিস।

মিথ্যা বলছে আলেশা মার্ট

আলেশা মার্টের প্রধানের দাবি, তারা এসকে ট্রেডার্সের কাছ থেকে ১ লাখ ১২ হাজার টাকা দরে বাজাজের পালসার কিনেছেন এবং সেই বাইক তারা ১ লাখ ১৮ হাজার টাকায় দিচ্ছেন।

তার এই দাবির সত্যতা খুঁজতে কথা বলেছে এসকে ট্রেডার্সের মালিক আল-আমিনের সঙ্গে। তার কাছে প্রথমেই জানতে চাওয়া হয়, ‘আলেশা মার্টের সঙ্গে আপনাদের চুক্তি আছে কি না?’

জবাবে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ। আলেশা মার্টের সঙ্গে আমাদের চুক্তি আছে।’

‘১৫০ সিসির ডাবল ডিস্কের পালসার আপনারা নাকি আলেশা মার্টকে ১ লাখ ১২ হাজার টাকায় দেন। এমনটা বলেছেন আলেশা মার্ট কতৃপক্ষ। বিষয়টা কি সত্য?’

এক প্রশ্নের জবাবে এসকে ট্রেডার্সের মালিক বলেন, ‘না না। এটা কী করে সম্ভব? ১ লাখ ১২ হাজার টাকায় পালসার ডুয়েল ডিস্কের বাইক সম্ভব না দেয়া। মূল প্রাইস ১ লাখ ৮০ হাজার ৯০০ থেকে আমরা কিছু ছাড় দিই।

‘সেটা অল্প কয়েক হাজার টাকা ছাড় হতে পারে। কারণ আমরা নিজেরাও আমদানি করি না। আমরা নিজেরাই সেলার। ১ লাখ ৬০ হাজারের নিচে তো আমরাও কল্পনা করতে পারি না। আলেশা মার্ট তাহলে আপনাদের সঠিক বলেনি।’

সব মিলে কত কর

মোটরবাইক আমদানিতে সব মিলে কর কত লাগে এ বিষয়টি নিয়ে এনবিআরের কাস্টমস শাখার প্রথম সচিব খায়রুল কবির মিয়ার (আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও চুক্তি) দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বেনাপোল কাস্টমসের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।

বেনাপোল কাস্টমসের উপকমিশনার নিয়ামুল ইসলাম বলেন, ‘বিদেশ থেকে একটা কমপ্লিট বাইক ইমপোর্ট করতে ১৫০% টোটাল ট্যাক্স ইনসিডেন্ট লাগে (টিটিআই)। টোটাল ট্যাক্স ইনসিডেন্টের মধ্যে কাস্টমস ডিউটি (সিডি), ভ্যাট, অ্যাডভান্স ট্যাক্স (এটি), সাপ্লিমেন্টরি ডিউটি (এসডি) এসব কিছু অন্তর্ভুক্ত।

‘আর যন্ত্রপাতি আমদানি করে দেশে অ্যাসেম্বল করলে ৫৮% টোটাল ট্যাক্স ইনসিডেন্ট দিতে হয়। দেশে পালসার বাইক অ্যাসেম্বল করে উত্তরা মোটরস। তাদের এই ৫৮% ট্যাক্স দিয়ে জিনিসপত্র আমদানি করতে হয়। এসিআই মোটরস ইয়ামাহার কিছু কমপ্লিট বাইক আমদানি করে। সে ক্ষেত্রে তাদের ১৫০% ট্যাক্স দিয়ে আনতে হয়।’

নজরদারিতে রাখতে হবেআহসান এইচ মনসুর

আলেশা মার্টের এই দুই ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেলের লোভনীয় অফার নিয়ে কথা হয় বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে।

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘এ ধরনের প্রতিষ্ঠান এক চালানের কাস্টমারের টাকা দিয়ে পরবর্তী চালানের কাস্টমারের পণ্য সরবরাহ করে থাকে। আলেশা মার্টের ক্ষেত্রেও এমনটা হতে পারে অ্যামাউন্টটা যদি বড় হয়। আর যদি বড় কোম্পানি হয়, সেটা ভিন্ন কথা।

‘কিন্তু আলেশা মার্ট অল্প সময়ের কোম্পানি। সে জন্য সরকারকে বিষয়টা খেয়ালে রাখা দরকার। আরেকটা বিষয় হলো, এ ধরনের অফার দিয়ে কাস্টমারের সঙ্গে যে কমিটমেন্ট বা ডিল, সেটা তারা মানছে কি না, সে বিষয়টা নজরদারিতে রাখতে হবে।’