ঢাকা, শুক্রবার ২৯ই মার্চ ২০২৪ , বাংলা - 

যে এলাকায় পানযোগ্য পানির হাহাকার

জেলা সংবাদদাতা।। ঢাকাপ্রেস২৪.কম

2021-03-05, 12.00 AM
যে এলাকায় পানযোগ্য পানির হাহাকার

পানির অপর নাম জীবন। তাই জীবন বাঁচাতে পানি পান করতেই হবে মানুষকে। কিন্তু, যেন তেন পানি পান করলে কী আর চলে। এজন্য দরকার নিরাপদ সুপেয় পানি। আর এই হাহাকারটাই বাজছে এখনও ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী হালুয়াঘাট-ধোবাউড়ার গারো পাহাড়ি জনপদে। এখানকার অন্তত ১০টি গ্রামে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট দিন দিন তীব্র হয়ে উঠছে। পানির স্তর অনেক নীচে নেমে যাওয়ায় টিউবওয়েলের পানির অভাবে এখনও এই জনপদের মানুষ কুয়ো ও পুকুরের পানি খাবারসহ গৃহস্থালি প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন। এ নিয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের উদ্যোগ না থাকায় হতাশ পাহাড়ি জনপদের মানুষ।

মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশ হালুয়াঘাটের গারো পাহাড়ের গাবড়াখালি গ্রামে সালমা বেগমের বাড়ি। গত ৪৫ বছর ধরে তিনি সংসার সামলাচ্ছেন এখানে। স্বামী হজরত আলীর সঙ্গে তার এই জীবনে যতবার মনোমালিন্য হয়েছে তার বেশিরভাগই ঘটেছে বাড়ির টিউবওয়েলে পানি না ওঠায়। তিনি মিস্ত্রি ডেকে সারাই করতে বলেন। হজরত আলীও নানা কষ্টের ভেতরেও মিস্ত্রি ডাকেন। কিন্তু, চেষ্টা সত্ত্বেও তার টিউবওয়েলে পানি ওঠে না। যে পানি ওঠে তা পান করা যায় না। ময়লা আর আয়রনসহ নানা সমস্যা সে পানিতে। কারণ, এখানে পানির স্তর নেমেছে অনেক নিচে। ৪৫ বছর আগে সংসার জীবনের শুরুতে তাদের টিউবওয়েরের ব্যবস্থা ছিল না, তখন পাশের বাড়ির কুয়োর পানি টেনে এনে খাবারসহ সংসারের গৃহস্থালি কাজ সারতেন। এখন এই বৃদ্ধ বয়সে এসেও তাকে আবারও সেই পানিই টানতে হচ্ছে পাশের বাড়ির কুয়ো থেকে। ঘরে টিউওেয়েল থাকলেও এখন আর সেটা কাজ করছে না।

দূরে পানি আনতে যাচ্ছেন নারীরাদূরে পানি আনতে যাচ্ছেন নারীরা
বিয়ের পর থেকেই এই প্রায় অর্ধ শতাব্দী সময়ে বিশুদ্ধ পানির সমস্যাটা পুরোপুরি দূর হতে দেখলেন না বলে আক্ষেপ করেন সালমা বেগম। তিনি জানান, গাবড়াখালি গ্রামে বউ হয়ে আসার পর থেকেই কুয়োর পানি টেনে এনে খাবার হিসেবে এবং পুকুর থেকে পানি তুলে গৃহস্থালি কাজে ব্যবহার করে আসছি। এই এলাকায় টিউবওয়েল নাই বললেই চলে। টিউবওয়েল বসাতে অনেক খরচ পড়ে যায়। এছাড়া কুয়ো সব বাড়িতে না থাকায় দূর দূরান্ত থেকে কুয়োর পানি টেনে আনতে হয়।

শুধু গাবড়াখালির সালমা বেগমই নন, হালুয়াঘাটের ডুমনিকুড়া, ভুটিয়াপাড়া, ধোবাউড়া উপজেলার দিঘলবাগ, ঘিলাগড়া, গোবরচুনা, রানীপুর, কড়ইগড়াসহ মেঘালয়ের পাদদেশের প্রায় ১০টি পাহাড়ি জনপদের মানুষের একই সমস্যা। দেশ এগিয়ে গেছে কিন্তু, তাদের খাবার পানির সমস্যার সমাধান হয়নি আজও।

দূরে পানি আনতে যাচ্ছেন নারীরাদূরে পানি আনতে যাচ্ছেন নারীরা
ভুটিয়াপাড়া গ্রামের শামসুল আলম জানান, সীমান্তের গারো পাহাড়ি এলাকায় পানির সমস্যা দীর্ঘদিনের। দেশে স্যানিটেশন নিয়ে এত কিছু হয় কিন্তু এই প্রত্যন্ত এলাকায় তার সুফল এখনও মেলেনি। স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা দূরে থাক আমরা এখনও পানযোগ্য বিশুদ্ধ পানিই পাই না। শুনেছি সরকার নাকি পানির সমস্যা মিটাতে অন্য এলাকায় অনেক অনেক ডিপ টিউবওয়েল বসায় দিছে। কিন্তু, এই এলাকা নিয়ে সরকারের কোনও উদ্যোগ পেলাম না। আমাদের চেয়ারম্যান মেম্বাররা সবাই সমস্যাটা জানে। এক দুইজনের তো আর সমেস্যা না, ১০ গ্রাম মানুষের সমেস্যা। কিন্তু, কেউ এখনও কিছু করলো না। বাচ্চাকাল থেইকে এই সমেস্যায় থাকতে থাকতে বুড়া হয়্যা গেলাম কেউ আমাদের দেখলো না।

শামসুল আরও বলেন, এখানে পান করার মতো পানি অনেক নিচুতে। অল্প পাইপ ব্যবহার করে সাধারন টিউবওয়েল বসিয়ে পানি পাওয়া যায় না। দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা খরচ করে রিংওয়েল টিউবওয়েল বসাতে পারলে তবেই খাবার বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যায়। আমরা গরিব মানুষ, আমাদের কী আর অমন সামর্থ্য আছে?

এ এলাকায় পানির হাহাকার এ এলাকায় পানির হাহাকার
সুপেয় পানির সমস্যাটার কথা স্বীকার করেছেন হালুয়াঘাটের গাজিরভিটা ইউনিয়নের গাবড়াখালি গ্রামের ইউপি সদস্য আবুল কাশেম। তিনি জানান, রিং ওয়েল টিউবওয়েল বসাতে বেশি খরচ পড়ায় গারো পাহাড়ি জনপদে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের মাধ্যমে সরকারি কোনও প্রকল্প নেওয়া হয় না। পানির সমস্যা সমাধানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রকল্প গ্রহণের দাবি করেছেন এই ইউপি সদস্য।

ধোবাউড়া দক্ষিণ মাউজপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফজলুল হক জানান, বিশুদ্ধ খাবার পানির সমস্যা দীর্ঘদিনের একটি সমস্যা। খরা মৌসুমে এই সমস্যা তীব্র হয়ে উঠে। বর্ষা মৌসুমে টিউবওয়েলে কিছু পানি পাওয়া গেলেও পরে আর পানি ওঠে না। সারা বছর তাই কুয়োর পানিই মানুষের খাবার পানির একমাত্র ভরসা। কুয়োতে ধুলোবালি উড়ে এসে পড়ে। ফলে পানি পেলেও এই পানি সরাসরি পান করার জন্য নিরাপদ থাকে না। এজন্য সারাবছরই এখানে ডায়রিয়ার মতো রোগ ঘরে ঘরে লেগেই রয়েছে।

এসব এলাকার মানুষের খাবার পানির সমস্যা সমাধানে সরকারের বিশেষ প্রকল্প হাতে নেওয়ার দাবি জানান দক্ষিণ মাউজপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফজলুল হক।

কূপ থেকে পানি তোলা হচ্ছেকূপ থেকে পানি তোলা হচ্ছে
খাবার বিশুদ্ধ পানির সংকটের কথা স্বীকার করে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরও। এই অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী জামাল হোসেন জানান, সারাদেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্পের কাজ চলছে। হালুয়াঘাট ধোবাউড়ার সীমান্ত এলাকায় পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাওয়ায় সাধারণ টিউবওয়েলে পানি পাওয়া যায় না। সীমান্ত এলাকায় রিংওয়েল টিউবওয়েল বসানোর প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে দাবি করে তিনি আরও জানান, ২০২৩ সালের মধ্যে এসব এলাকায় পানির সমস্যা আর থাকবে না।

জেলা প্রশাসক মিজানুর রহমান জানান, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের সহায়তায় দ্রুতই পাহাড়ি জনপদের মানুষের খাবার পানি সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে।এসব পাহাড়ি জনপদের মানুষের পানির সমস্যা সমাধানে দ্রুতই উদ্যোগ নেবেন সরকার এমনটাই প্রত্যাশা সকলের।